সমাজ সাহিত্যের ক্যানভাস

প্রকাশিত: ১৮ জুলাই ২০১৭, ১২:৫৫ পিএম

সাহিত্য সমাজের অনুগামী এ কথা সত্য। তবে সমাজের মানুষের মধ্যে সাম্য, মৈত্রী ও মিলন এ ত্রিবেণী বন্ধন সৃষ্টিতে এবং কালান্তরে লোকাচারকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহিত্যের ভূমিকা ব্যাপক। সাহিত্য ও সমাজের সম্পর্কটা সুপ্রাচীন হলেও সময়ের বিবর্তনে সাহিত্য ও সমাজের সম্পর্কে মতান্তর ঘটেছে। কেননা সাহিত্যে পরিবর্তিত সমাজের প্রতিফলন ঘটে। সমাজ বিনির্মাণে আদর্শ ও দর্শন সরবরাহে সাহিত্য স্বমহিমায় আবর্তিত হয়। এতে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। তবে সমাজ ছাড়া সাহিত্য অচল। আবার সাহিত্য সমাজকে বিচার বিশ্লেষণ করে বলেই সমাজের অস্তিত্ব, গতিধারা এমনকি ভিশন ও মিশন বিনির্মাণে সাহিত্যের মুখাপেক্ষী হয়। সাহিত্যেই সমাজের অনগ্রসরতা বা প্রাগ্রসরতার দলিল। বহমান সমাজ সীমাহীন তীর হারা নদীর মতো চলার পথে সাহিত্য তার তীর বেঁধে দেয়, তাকে নিয়ন্ত্রণের উপায় নির্দেশ করে এবং গতিশীল হবার পরামর্শ দেয়। সাহিত্যের মূল্যায়নে সমাজ সার্থকতা পায় বলেই সমাজকে অভিহিত হয় সাহিত্যের আপন ক্যানভাস অভিধায়। অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর কবিতায় বলেন, “সাহিত্য যেমন সমাজ থেকে কিছু নেয়,/আবার সমাজকেও সাহিত্য অনেক কিছু দেয়।”

সাহিত্যিক যেহেতু সমাজেরই একজন, তাই সাহিত্যে তিনি তার ব্যক্তিমনের নিভৃতে সঞ্চিত আশা-আকাক্সক্ষা, কল্পনাকে পরিস্ফুট করার পাশাপাশি প্রকাশ করেন দেশ-কাল-সমাজের একটি বিশেষ রূপ। সমাজ ছাড়া সাহিত্যিকের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। আবার সাহিত্যিক ছাড়াও আধুনিক সমাজের কথা ভাবা যায় না।

সমাজকে কেন্দ্র করেই সভ্যতা বিকশিত হয়। সামাজিক জীব হিসেবে সাহিত্যিক তার রচনায় সমাজের প্রতিফলন ঘটান। সাহিত্য সৃষ্টিতে সাহিত্যিক কল্পনার আশ্রয় নেন। তবে এই কল্পনার সাথে বস্তুগত বিষয়ও থাকে। আর এ বস্তুস্পর্শ লাভ করা যায় জীবন তথা সমাজ থেকে। আনন্দ মানবজীবনের একটি অংশ। আর সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষ আনন্দ লাভ করে। তাই আনন্দকে বাদ দিয়ে সাহিত্য সার্থক হয় না। কাজেই জীবনের সঙ্গে সাহিত্যের সংযোগ যেমন বস্তুসত্তার দিক দিয়ে, তেমনি আনন্দের দিক থেকেও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

সাহিত্য দুই ধরনের একটি ভাবপ্রধান, অন্যটি বস্তুপ্রধান। দুই ধরনের সাহিত্যেই রয়েছে জীবনের বিশ্লেষণ তথা সমাজজীবনের চিত্র। যে লেখক যত সূক্ষ্মভাবে জীবনকে প্রত্যক্ষ করতে পারেন তাঁর সাহিত্যে সমাজ ততো জীবন্ত হয়ে ওঠে। সাহিত্য হলো সমাজনির্ভর শিল্প। তাই সাহিত্যে সমাজের কথা, সমাজবদ্ধ মানুষের কথা থাকে। সমাজের গতি যুগ ধর্মকে অবলম্বন করে। পরিবেশ পরিস্থিতি যুগধর্মের নিশান। পরিবেশ আপনা-আপনি নির্মিত হয় না। এর পেছনে কাজ করে নানা কার্যকারণ আর সে কার্যকারণ সৃজিত হয় প্রকৃতির প্রতি মানুষের আচরণ, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারের মাত্রা দ্বারা। মানুষ প্রকৃতির কোলে প্রতিপালিত হয়, প্রকৃতিকে আত্মস্থ করে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে কিংবা প্রকৃতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে মানুষ শুধু জীবনযাপনই করে না, সেই জীবনের নানা প্রেক্ষাপট। সহায়-সম্পদ সৌধ নির্মাণ করে এবং রূচি অভিরূচি কিংবা অরুচির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

এভাবেই প্রকৃতির সঙ্গে অভিযোজন করে গড়ে ওঠে মানবজীবনের নানা পর্ব। লিও টলস্তয়ের আন্না কারেনিনার চরিত্রগুলো রাশিয়ার সমকালীন সমাজ জীবনের শাশ্বত আভিজাত্যবোধের ক্যানভাসে মানব মানবীর আবহমান সম্পর্কের, সংশয় সন্দেহের সখ্যের সর্বনাশের উপাখ্যান স্পষ্ট। ক্ষয়িষ্ণু আর উঠতি সমাজের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও মেলবন্ধনের মহাকাব্যিক বর্ণনায় লেখক লিও টলস্তায় প্রকারান্তরে সামন্তবাদী সমাজজীবনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলোকে রূপকের অন্তরালে এমনভাবে উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন যাথে সমাজ-দর্শন ও বিবর্তনে এক বিস্তারিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট উপস্থাপিত হয়েছে। আবার পার্ল এস বাকের এড়ড়ফ ঊধৎঃয-এ জীবন আর প্রকৃতির নিরন্তন সংগ্রাম সৌহার্দের যোজনা লক্ষণীয়। সেক্সপিয়রের সেনাপতি, রাজা, যুবরাজ, প্রেমিক, ভাঁড় এমনকি কুটবুদ্ধির চরিত্রগুলো অনায়াসেই সমাজ দর্শনের কথা বলে যাতে যুগযুগান্তরের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার নির্যাস বেড়িয়ে আসে, নিছক মনোরঞ্জনের জন্য নয়, সমাজ কাঠামোর মধ্যেকার সবল ও দুর্বলের দিকগুলো শনাক্তকরণের উদ্দেশ্য সেখানে গোপনীয় নয়। দস্তয়ভস্কির ঈৎরসব ধহফ চঁহরংযসবহঃ-এর কুশীলবরা সমাজের ন্যায়-অন্যায়ের অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রতীকীপীড়ায় প্রশ্ন তোলে- কারণ ও প্রতিক্রিয়ার আনুভূমিক সম্পর্ক ও তার চৌহদ্দি সম্পর্কে। প্রায় শতবর্ষের কাল পরিক্রমার ক্যানভাসে আনন্দ-বেদনার এক মহাকাব্য রচিত হয় চীনা সমাজে। তিন পুরুষের সংগ্রাম আর সন্ধির আয়নায় দেখা অসংখ্য ঘটনা ও অসংখ্য আকর্ষণ বিকর্ষণের অবয়বে এ উপাখ্যান সৃজিত।

যাইহোক, সমকালীন সমাজের রূপান্তর আমাদের নিকট উপস্থাপিত হয় চরিত্রনিচয়ের আবেগ ও অনুভূতি উপলব্ধির মাধ্যমে। নগরায়ন ও শিল্প বিল্পব এসেছে, গ্রামীণ জীবন থেকে নাগরিক জীবনে অনুপ্রবেশের অন্তরালে স্মৃতিভাণ্ডারে যে দোলাচাল সৃষ্টি হয়েছে, চেতনার কার্নিশে জলপড়ে পাতা নড়ে যে অনুরণন সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে পাঠক মাত্রেই উপলব্ধি করে নষ্টালজিক নান্দনিকতা। শরৎচন্দ্রের বহুলপঠিত ‘দেবদাস’ উপন্যাসে তাল সোনাপুর গ্রামের পার্বতী-দেবদাসের আবল্য কৈশোর ও বয়োসন্ধির আবেগ উৎকণ্ঠাকে শহুরে চুনিলাল চন্দ্রমুখীর দগ্ধ জীবনবোধের সাথে কালান্তরে এক অভিনব সমান্তরাল রৈখিক চিত্রে উপস্থাপিত হয়েছে। এখানে লেখক মানবজীবনের সার্বজনীন কাব্যগাথা এবং নিত্যতা নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছেন। তাল সোনাপুর আবহমান গ্রাম বাংলার মতোই একটি অতি সাধারণ গ্রাম যা দেবদাস-পার্বতীর গ্রাম হিসেবে পেয়ে সুখ্যাতি পেয়েছে একটি কালজয়ী সাহিত্যের মাধ্যমে। সাহিত্য সমাজকে এভাবেই কালান্তরে পৌঁছে দেয়। নগর আর গ্রামীণ জীবনের ক্যানভাসে বিবর্তনের প্রান্তসীমায় মানব সম্পর্কের আটপৌরে অবয়ব, আনন্দ-বেদনা অভিমান আক্ষেপের, আভিজাত্য আর শাশ্বত হৃদস্পন্দন প্রয়াসের দ্রুপদী সংগীত এখানে মুর্ছনা ছড়ায়।


আনুমানিক দু’হাজার বছর পূর্বে মিশরে লিখিত বিভিন্ন কাহিনিতে সে সময়ের সমাজ-বাস্তবতার চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্যেও সমাজচিত্র অঙ্কিত হয়েছে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের রচনায় সমাজের ছবি বার বার ধরা দিয়েছে, প্রকাশ পেয়েছে সমাজ সম্পর্কে তাদের মনোভঙ্গি। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ রচনায় রাশিয়ার সমাজবাস্তবতার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। সংস্কৃত ভাষার কবি কালিদাসের রচনাবলিতে আমরা গুপ্তযুগের ভারতবর্ষের একটি আনুপূর্বিক জীবনচিত্রের সন্ধান পাই। চার্লস ডিকেন্স, ফ্লবেয়ারের কথাসাহিত্যে সমাজের বাস্তবচিত্র যথাযথভাবে রূপায়িত হয়েছে।


পৃথিবীর সব দেশের সাহিত্যের মতোই বাংলা সাহিত্যেও সমাজজীবনের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের সূচনাপর্ব থেকেই কবি-সাহিত্যিকদের সমাজচেতনা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। চর্যাপদবাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন। এগুলো বৌদ্ধ সহজিয়া সম্প্রদায়ের সাধন সংগীত। তারা নিগূঢ় তত্ত্বকথা বলতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত রূপক, প্রতীক ও অলংকারের। তাই ধর্মকে ছাপিয়ে মানুষ ও সমাজবাস্তবতাই এখানে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। সেই হাজার বছর আগে বাঙালি সমাজে শ্বশুর-শাশুড়ি পরিবৃত যৌথ সমাজ ছিল। সেকালের মানুষরা নৌকা তৈরি করত, শিকার করতে যেত বনাঞ্চলে এবং নারীরা ছিল আজকের মতোই প্রসাধনপ্রিয়। দারিদ্র্যপীড়িত সমাজজীবনের চিত্র রয়েছে চর্যাপদে। ৩৩নং চর্যায় স্পষ্টই বলা হয়েছে টালত মোর ঘর নাহি পড়বেসী/হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী।


অর্থাৎ টিলায় আমার ঘর, প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে ভাত নেই অথচ নিত্য অতিথি আসে। চর্যাপদে খুঁজে পাওয়া যায় বর্ণাশ্রমপীড়িত শ্রেণিভিত্তিক সমাজের চিত্র। বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের রচনা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কৃষ্ণ ও রাধার হৃদয়-বেদনার কথামালা হলেও তা যেন সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। এ কাব্যে কৃষ্ণ অশিক্ষিত যুবক, দেবতা নন। অন্যদিকে রাধাও দেবী নন। তিনি মানবিক বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ রক্তমাংসের মানুষ তার সমাজে লাজলজ্জার ভয় আছে। এখানে অসম বিবাহ ও তার বেদনাময় পরিণতি, হাঁচি টিকটিকি প্রভৃতি কুসংস্কার, নারীদের বিচিত্র সাজসজ্জা, নারী-পুরুষের প্রেমের চিত্র স্পষ্ট। মধ্যযুগের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন মঙ্গলকাব্যে যেসব দেব-দেবী প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন তাঁরা সমাজের অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর শ্রেণির পূজা পেয়েছেন প্রথমে, পরে সমাজের তথাকথিত উচ্চবিত্তে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। মঙ্গলকাব্যে তৎকালীন সমাজজীবনের দুঃখ, দারিদ্র্য, আনন্দ-বেদনা প্রভৃতির চিত্র রূপায়িত হয়েছে।


উনিশ শতকের প্রারম্ভ থেকেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সূচনা ঘটে। তখনকার মানুষের সামাজিক জীবনচর্চার পরিচয় পাওয়া যায় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’ বা ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ ও মীর মশাররফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পণ’-এর মতো নাটকে। গীতিকবিতা উনিশ শতকের বিশিষ্ট সৃষ্টি। ব্যক্তি হৃদয়ের উপলব্ধি এ ধরনের সাহিত্য সৃষ্টির মূল প্রেরণা। কিন্তু সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তি-উপলব্ধির প্রকাশ ঘটানো সম্ভব ছিল না। আধুনিকতার সূচনার সঙ্গে সাহিত্যেও অভাবনীয় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। গীতিকবিতা সমাজজীবন আশ্রিত ব্যক্তিঅভিজ্ঞতারই এক নান্দনিক প্রকাশ। আঠারো শতকের শেষার্ধে এবং উনিশ শতকের প্রথমার্ধে যে কবিগান ও শায়েরের সৃষ্টি হয়েছিল তা তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা ও অব্যবস্থারই ফল। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনায় বাংলা কথাসাহিত্যে ‘বাবু’র সঙ্গে ‘বাবু’র ধারক ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় । তাঁর ‘নব বাবু বিলাস’ (১৮২৫) এ ধরনের সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। ক্যাথেরিন ম্যুলেন্সের লেখা ‘ফুলমনি ও করুণা’র বিবরণে (১৮৫২) খ্রিষ্ট ধর্মান্তরিত বাঙালি পরিবারে ধর্মজীবনের সমস্যাকে কেন্দ্র করে এক পূর্ণতর সমাজচিত্র অঙ্কিত হয়েছে। তার কিছু সময় পর লেখা তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘স্বর্ণলতা’য় (১৮৭৪) বাংলার পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের চিত্র রূপায়িত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনেক উপন্যাসে সমাজজীবন ও সমাজব্যবস্থর রূপ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ (১৯১০) উপন্যাসে বৃহত্তর সমাজ কাঠামোর পরিচয় আমরা পাই। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসে মূলত সমাজের নির্মমতার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এবং এ সমাজের প্রতি ঔপন্যাসিকের সহানুভূতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ এবং অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের দুঃখ-দারিদ্র্য ও জীবনচেতনার এক অনুপম কথামালা। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোটগল্পে সমাজের মধ্যবিত্ত, কেরানি শ্রেণি ও নিম্নবিত্ত মানুষের পরিচয় পাই। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসে রাঢ় বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের পরিচয় পাই।


সমাজজীবন সাহিত্যকে কীভাবে প্রভাবিত করে তার প্রচুর দৃষ্টান্ত রয়েছে বাংলা নাটকে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ (১৮৬০) প্রহসনে তৎকালীন বাবু সমাজের তথা ইংরেজি শিক্ষিত নব্য যুবকদের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। তাঁর ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনে তিনি তুলে ধরেছেন ধনী, চরিত্রহীন জমিদারের চরিত্র। দীনবন্ধু মিত্র তাঁর ‘সধবার একাদশী’ (১৮৬৬)-তে অধঃপতিত ইয়ং বেঙ্গল সমাজের প্রকৃত চিত্র অঙ্কন করেছেন। ‘নীলদর্পণ’ (১৮৬০) নাটকে তিনি নীলকরদের অত্যাচার এবং প্রজাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরেছেন। গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘প্রফুল্ল’ (১৮৮৯) নাটকে সামাজিক সমস্যার সংবেদনশীল চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ (১৯২৬) নাটকে যন্ত্রসভ্যতার প্রতিঘাতে যন্ত্রণাদগ্ধ সমাজের বাস্তব রূপ চিত্রিত হয়েছে। বাংলা কবিতায়ও সমাজজীবনের নানা দিক ফুটে উঠেছে। কাজী নজরুল ইসলাম কাব্যের মাধ্যমে সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্যেও সমাজচেতনার বিষয়টি লক্ষণীয়। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার প্রধান লক্ষণ হলো যুগ চেতনা ও সমাজ-মনস্কতা। তাঁর ‘পদাতিক’, ‘ছাড়পত্র’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ এরই স্বাক্ষর বহন করে। জসীমউদদীনের কবিতায় গ্রামবাংলা ঐতিহ্য ও সমাজজীবন প্রাধান্য লাভ করেছে। অত্যন্ত সফলভাবে তিনি গ্রাম্যজীবন ও গ্রামবাংলার পরিবেশকে কাব্য রচনার উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাঁর ‘নকশি কাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ প্রভৃতি কাব্যে বাংলার মানুষ ও প্রকৃতি বাঙময় হয়ে উঠছে। প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর কবিতায় প্রথম ঘোষণা করেন “আমি কবি যত কামারের আর কুমারের, মুটে মজুরের।” শ্রমজীবী সমাজকে তিনি তাঁর বিভিন্ন কবিতায় তুলে ধরেছেন। মানব জীবন ও মনের ওপর ভিত্তি করেই সাহিত্যসৌধ নির্মিত হয়। সমাজজীবনে নানা সংকট বিদ্যমান। সাহিত্য সমাজের এ সংকট থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়। তাই একজন সাহিত্যিককে সমাজের কল্যাণের দিকে লক্ষ রাখা উচিত এবং সাহিত্যে তার প্রকাশ ঘটানো সাহিত্যিকের কর্তব্যে। সমাজ সচল আর জীবন ক্ষয়িঞ্চু। তাই সমাজ ও জীবনের নানা উপাখ্যান প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দিতে সাহিত্যই অনন্য মাধ্যম।

খোলা কলামে প্রকাশিত সব লেখা একান্তই লেখকের নিজস্ব মতামত। এর সাথে পত্রিকার কোন সম্পর্ক নেই।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: