'সেদিন থেকে কেন জানি কণ্ঠ ছেড়ে আর গান করতে পারতাম না'

প্রকাশিত: ১৫ আগষ্ট ২০১৭, ০৩:৫৮ পিএম

ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বর্হিবিশ্বে বাঙালির অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল বিলাতের পথ ধরে। সেজন্য বাংলাদেশের বাইরে সবচে’ বড় বাঙালি জনগোষ্ঠী যেমন বিলাতে গড়ে ওঠেছে, ঠিক তেমনি রয়েছে বিলাতবাসী বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বিলাতে বাঙালির সেই বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চায় যারা নিষ্ঠার সঙ্গে নিবেদিত ফারুক আহমদ তাদের একজন। বিশ শতকের নয় দশকের গোড়া থেকে আজ অবধি তিনি এ পথের নিরলসযাত্রী। তার গবেষণামূলক ইতিহাস গ্রন্থের তালিকায়, ‘বিলাতে বাংলা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা’, ‘বিলাতে বাংলার রাজনীতি’, ‘বিলাতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা’ এবং ‘বিলাতে বাঙালি অভিবাসন’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

ফারুক আহমদের জন্ম ১৯৬৪ সালের ২২ জানুয়ারি সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানার গোয়াসপুর গ্রামে। বিশ শতকের আট দশকের গোড়ার দিক থেকে সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত। রেডিও বাংলাদেশের অনুমোদিত গীতিকার ও নাট্যকার। ১৯৯৪ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত মাসিক লন্ডন বিচিত্রা পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: ‘এ মাটির বাউল’ (গীতিকবিতা: ১৯৯৪); ‘বিলাতে বাংলা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা (২০০২); ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি’ (২০০৭); ‘বিলাতে বাংলার রাজনীতি’ (২০১২); ‘গোলাপগঞ্জের ইতিহাস’ (২০১৫); ‘সাপ্তাহিক জনমত : মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল’ (২০১৬)। প্রকাশিতব্য: ‘বিলাতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা’ (২০১৫); ‘বিলাতে বাঙালি অভিবাসন’। 

সম্পাদনা করেছেন লন্ডনবাসী সাংবাদিক ও বাম রাজনীতিবিদ তাসাদ্দুক আহমদের জীবনীমূলক গ্রন্থ ‘জীবন খাতার কুড়ানো পাতা’ (২০০২)সহ আরও অনেকগুলো গ্রন্থ। ২০১৩ সালে তিনি তার গবেষণামূলক লেখালেখির জন্য প্রবাসে সমকালীন বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্যে " বাংলা একাডেমি প্রবাসী সাহিত্য পুরস্কার ২০১৩ অর্জন করার গৌরবোজ্জ্বল এ নিভৃতচারী মানুষ আমাদের বিষ্ময় দূর ব্রিটেনে যেখানে বিলগ্ন সোনার খুঁজে ব্যতিব্যস্ত ব্রিটেন প্রবাসী বহির্বিশ্বের নিরুপায় মানুষ, সেখানে তিনি কিভাবে সোনার খাঁমিতে এমন নির্লোভ, এমন নির্লিপ্ত, এই সব অমিমাংশিত প্রশ্নের খুঁজে Bd24live.com এর মুখোমুখি হয়েছিল জনাব ফারুক আহমদের। তার সাহিত্য ও স্বদেশ ভাবনার অনুলিখনে সাথে ছিলেন কবি স্বপন মোসলমান।

প্রশ্ন: জীবনে কী হতে চেয়েছিলেন?

উত্তর: বাল্যকালে স্বপ্ন ছিল বাস ড্রাইভার হবো। বাড়ি পাশ দিয়ে ড্রাইভারেরা যখন জোরে জোরে যারা গাড়ি চালিয়ে যাওয়া আমাকে খুবই আন্দোলিত করত। পরে স্কুলে গিয়ে দেখলাম প্রধান শিক্ষকের খুবই দাপট। তাই সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে প্রধান শিক্ষক হবার স্বপ্ন বুকে লালন করতাম। এভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চাওয়া-পাওয়ার স্বপ্নও পাল্টাতে থাকে।

প্রশ্ন: লেখালেখিতে কীভাবে এলেন? আমরা শুনেছি আপনি এর আগে গান ও নাটক লিখতেন। বেশ কয়েকটি বই সম্পাদনা করেছেন, অনুলিখনও করেছেন। এ বিষয়ে কিছু বলুন।

উত্তর: হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। তবে যা শুনেননি তা হচ্ছে এক সময় আমি গানও করতাম। স্কুলজীবনের একটি ঘটনা আমার কণ্ঠ থেকে গান কেড়ে নিয়ে হাতে কলম তুলে দেয় এবং আমি লিখতে শুরু করি। পরিণামে রেডিও বাংলাদেশে সিলেট কেন্দ্রের গীতিকার ও নাট্যকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হই। এই পরিচয় নিয়েই আমার লন্ডনে আসা ও বসতি। আমার প্রথম বইটিরও ছিল গীতিকবিতার বই, ‘এ মাটির বাউল’। মুখবন্ধ লিখেদিয়েছিলেন কবি দিলওয়ার। প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে লন্ডন থেকে। এর পরের বছর দ্বিতীয় গানের বই প্রকাশ করার জন্য পা-ুলিপি প্রস্তুত করেছিলাম। মুখবন্ধ লিখে দিয়েছিলেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী। বইটির নাম ‘আমার তনে কান্দে মন’। কিন্তু প্রকাশ করবো, করছি করতে করতে এখনো প্রকাশ করা হয়নি। সম্পাদনা করেছি পঞ্চাশের দশকের ঢাকার বিশিষ্ট সাংবাদিক-কলামিস্ট তাসাদ্দুক আহমদের লেখা স্মৃতিচারণমূলক লেখা ‘জীবন খাতার কুড়ানো পাতা’। রাজনীতিবিদ আব্দুল মুনিমের, ‘সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের গোড়ার কথা’। সাংবাদিক-কলামিস্ট ইসহাক কাজলের ওপর (যৌথভাবে), ‘একজন ইসহাক কাজল’। অনুলিখন করেছি,‘বিলাতবাসী প্রবীন ক্যাটারার আব্দুল গফুরের আত্মজীবনী, ‘এক ব্রিটিশ-বাঙালির আত্মকথা’ ইত্যাদি।

প্রশ্ন: গান গাওয়া ছেড়ে দেবার কারণটা কি জানতে পারি। অর্থাৎ কোন ঘটনা আপনার কণ্ঠ থেকে গান কেড়ে নিয়ে হাতে কলম তুলে দিলো

উত্তর: ঘটনাটি ঘটে ১৯৭৪ সালে। আমি তখন গোলাপগঞ্জ এম সি একাডেমিতে পড়ি। একসঙ্গে বরীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী পালিত হবে। হবে সঙ্গীত প্রতিযোগিতাও। সহপাঠীদের অনুরোধে আমিও প্রতিযোগিতায় অংশ নিলাম। গানটি ছিল আব্বাস উদ্দিনের পল্লিগানের সুরে গাওয়া একটি নজরুল গীতি। প্রতিযোগিতায় গানটি গাওয়ার পরে অনেকক্ষণ ছাত্রছাত্রীরা হাততালি দেয়। কিন্তু জয়মাল্য আমার ভাগ্যে জুটলো না, আমি প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় কোনো স্তরের পড়লাম না। পুরস্কার ঘোষণার সময় আমাদের প্রধান শিক্ষক মহোদয় জানালেন, নজরুল গীতি আমি যেভাবে গেয়েছি সেভাবে গাওয়া হয় না। তাই গানটি সবার শুনতে ভালো লাগলেও আমাকে পুরস্কৃত করা গেল না। তখন শিক্ষকদের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করার মতো বয়স কিংবা সাহস কোনোটাই আমার ছিল না। অনুষ্ঠান শেষে স্কুলের বাংলার শিক্ষক আব্দুর রহমান চৌধুরীকে (কাছাড়ি স্যার) ফলাফল শুনে তাকে অনেকটা হতাশ বলেই মনে হয়েছিল। আমি পুরস্কার না পাওয়ায় সহপাঠী ছাত্রছাত্রী প্রায় সবাই হাসাহাসি করলো। অনেকে বললো, বোকা তুই নজরুল গীতির অনুষ্ঠান পল্লীগীতি গাইলে কেন? যাক অনুষ্ঠান আব্দুর রহমান স্যার আমাকে ডেকে নিয়ে চুপি চুপি বললেন, তুমি কি দুঃখ পেয়েছ? আমার মুখ দিয়ে তখন কোনো কথাই বেরুচ্ছিল না। তিনি আমাকে শান্তনা দিতে গিয়ে বললেন, ‘তুমি নজরুল গীতিই গেয়েছ এবং ভালোভাবেই গেয়েছ। কিন্তু স্যাররা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি আগে জানলে প্রতিবাদ করতাম, কিন্তু ফলাফল ঘোষণার পরে স্যারদেরকে খাটো করতে চাইনি। তুমি গান গাওয়া চালিয়ে যাও। তবে পল্লীগীতি গাইলে ভাল করবে।’ কিন্তু স্যারের কথা রাখতে পারিনি। সেদিন থেকে কেন জানি কণ্ঠ ছেড়ে আর গান করতে পারতাম না, এখনো পারি না।

প্রশ্ন: গানের জগৎ থেকে ইতিহাস চর্চার ভূবনে কীভাবে এলেন?

উত্তর: এ বিষয়ে আমার প্রথম শিক্ষক সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের কর্ণধার মুহম্মদ নুরুল হক। তার বড় ছেলে আজিজুল হক মানিক আমার সহপাঠী। সেজন্য তিনি আমাকেও ছেলের মতো স্নেহ করতেন। ইতিহাস১৯৮০ সালে কলেজে অধ্যয়নকালীন অবসর কাটতো সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে আড্ডা দিয়ে। তখন পদ্যজাতীয় কবিতা, গান, গল্প এবং নাটক লেখারচর্চা করতাম, এ নিয়ে পড়াশোনাও করতাম। আমার এ কাজগুলো সংসদের সেক্রেটারি মুহম্মদ নুরুল হকের নজরে পড়ে। একদিন কাছে ডেকে নিয়ে জানতে চান কোন বিষয়ে আমার আগ্রহ বেশি। উত্তর শুনে বলেন, ‘লাইব্রেরির প্রতি মোহ দেখে মনে হচ্ছে, আপনি সময়-সুযোগে ইতিহাস-ঐতিহ্যের সন্ধান করলে ভালো করবেন। এই মুসলিম সাহিত্য সংসদের কথাই ধরুন। এটি গড়ে ওঠার পেছনেও একটি চমৎকার ইতিহাস আছে। সংশ্লিষ্টরা সবাই একে একে চলে যাচ্ছেন। সময়-সুযোগে নোট নিয়ে রাখলে একসময় দেখবেন এ প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাস লেখার মতো উপাদান হয়ে গেছে। তখন লিখতে সময় লাগবে না। কাজ এভাবেই করতে হয়।’

প্রিয় লেখক,এটা সর্বজন বিদিত যে বাঙ্গালী বই বিমুখ, তবু যে আমাদের সাহিত্যশিল্প'টা একেবারে উচ্ছন্নে যায়নি তার আৃার মতে তার কৃতিত্ব আপনাদের মতো নিভৃত বাহকের, যারা নিরালোক বারান্দায় বয়ে বেড়ান নিজের সংস্কৃতির ব্যাটন, যার জন্যে পরবর্তী প্রজন্মের কেউ তার সন্ধান করলে সহজেই খুঁজে নিতে পারে, আর এভাবেই আমাদের আবহমান সংস্কৃতি ক্রম প্রসারিত হচ্ছে, আর এই অনুর্বর প্রান্তরের সূর্য সৈনিক হিসাবে Bd24live.com'এর পক্ষ হতে আপনাকে আন্তরিক অভিবাদন।

লেখক : আপনাকেও অভিবাদন।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: