‘বিশ্ববাসীর পর্যবেক্ষণে ভয় পাই না’

প্রকাশিত: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০৯:১০ এএম

সারাবিশ্বের সমালোচনার তীর যখন বিদ্ধ করছে তখন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি সব রকম মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সহিংসতার নিন্দা জানালেন। রাখাইনে সহিংসতায় যারা দুর্ভোগে পড়েছেন তাদের সবার প্রতি প্রকাশ করেছেন গভীর সহানুভূতি। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাখাইনে নির্যাতনের জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা হবে। সহিংসতার একটি টেকসই সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো ও বিশ্লেষকরা বলছেন, এ বক্তব্যে সুচি মিথ্যাচার করেছেন। তিনি বাস্তবতা এড়িয়ে গেছেন।

অং সান সুচি বলেছেন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন একটি কমিশনের নেতৃত্ব দিতে। রাখাইনে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা সমাধানে এই কমিটি সাহায্য করবে মিয়ানমারকে। সুচি আরো বলেছেন, যেসব রোহিঙ্গা ফিরে যেতে চান তাদের শরণার্থী হিসেবে মর্যাদা (রিফিউজি স্ট্যাটাস) যাচাই করতে প্রস্তুত মিয়ানমার। কিন্তু তিনি রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশনস’ নিয়ে কোনোই মন্তব্য করেননি। এমন কী রোহিঙ্গা শব্দটি মুখে উচ্চারণও করেননি। তিনি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের পর্যবেক্ষণে তিনি ভীত নন।

তিনি বলেছেন, ৫ই সেপ্টেম্বরের পরে আর কোনো সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়নি। আর কোনো ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ও চালানো হয়নি। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস নির্যাতন শুরুর পর সারাবিশ্ব অং সান সুচির প্রতি আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে সহিংসতা থামাতে। রোহিঙ্গা নির্যাতনের নিন্দা জানাতে। সর্বশেষ জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টানিও গুতেরাঁ তাকে সতর্ক করে দেন। তিনি জানিয়ে দেন সুচির জন্য শেষ সুযোগ। তিনি যদি এই সুযোগের সদ্ব্যবহার না করেন তাহলে করুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে। এরপর প্রথমবার মুখ খুললেন অং সান সুচি। তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন মঙ্গলবার মিয়ানমারের সময় সকালে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন শুরু হয়েছে সোমবার। ভৌগোলিক কারণে তখন মিয়ানমারে মঙ্গলবার। তিনি তাই এ সময়টাকেই তিনি বেছে নিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে সুচি বলেছেন, জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে তিনি সক্ষম হননি। তাই বিশ্ববাসীকে তিনি জানাতে চান, রাখাইনের পরিস্থিতিতে তার সরকার কী করছে। ওই ভাষণে তিনি বলেছেন, রাখাইনের বেশির ভাগ মুসলিম রাজ্য ছেড়ে পালায়নি। রাজ্যের সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। ওদিকে তিনি তার বক্তব্যে দৃশ্যত রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে কতজনকে ফেরত নেবেন তা নিশ্চিত নয় এবং ফেরত নিলেও তাদের দৃশ্যত নাগরিকত্ব দেয়া হবে না। কারণ, তিনি তাদের শরণার্থী হিসেবে মর্যাদা যাচাই করে দেখতে প্রস্তুতির কথা বলেছেন। অর্থাৎ ফেরত নিলেও রোহিঙ্গাদের নেয়া হতে পারে শরণার্থী হিসেবে। 

সুচি বক্তব্যে জানিয়ে দিয়েছেন (রাখাইন) রাজ্যজুড়ে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। (সহিংসতার) দায় খণ্ডিতভাবে কারো ওপর দেয়ার কোনো ইচ্ছা নেই মিয়ানমার সরকারের। একই সঙ্গে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ারও কোনো বাসনা নেই। রয়টার্স, অনলাইন সিএনএন, বিবিসি, দ্য হিন্দুস্তান টাইমস-এর খবর। এতে বলা হয়, জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেও একটিবারের জন্য রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেননি সুচি। এ শব্দটি ব্যাপক অর্থে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বোঝাতে ব্যবহার করা হয়।

গত ২৫শে আগস্ট রাখাইনে পুলিশ ও সেনাদের অবস্থানে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) হামলা চালায় বলে কর্তৃপক্ষ বলছে। এরপর সেনারা রোহিঙ্গাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন শুরু করে। তার ফলে চার লাখ ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাধ্য হয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। সেনাবাহিনীর এ অভিযানকে জাতিসংঘ জাতি নিধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তবে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সুচি এ অভিযোগেরও কোনো জবাব দেননি। তবে তিনি বলেছেন, আমরা অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ শুনছি। সবার কথা শুনতে হবে আমাদের। আমাদেরকে নিশ্চিত হতে হবে, এসব অভিযোগ নিরেট প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। তারপরই আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। মানবাধিকার লঙ্ঘন, স্থিতিশীলতা, সাম্প্রদাকি সম্প্রতি ও আইনের শাসনকে খর্ব করার বিষয়টি দেখা হবে কঠোরভাবে আইনের আওতায়। জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা হবে।

তিনি আরো বলেন, সহিংসতার শিকার হয়েছেন যেসব মানুষ তাদের সবার প্রতি আমরা গভীর সমবেদনা প্রকাশ করি। ওদিকে রাখাইনে সামরিক অভিযান বন্ধ করতে এবং সেখানে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেয়ার সুযোগ দেয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে যেসব মানুষ বাড়িছাড়া হয়েছেন তাদেরকে নিরাপদে বাড়ি ফেরায় সহায়তা করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স লিখেছে, নিরাপত্তার পূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে। কিন্তু তাদের অভিযানের বিষয়ে কোনোই মন্তব্য করেননি সুচি।

তিনি বলেছেন, সীমান্ত অতিক্রম করে বিপুল সংখ্যক মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছে- এটা শুনে আমরা উদ্বিগ্ন। কেন তারা দেশ ছাড়ছে তার কারণ অনুসন্ধান করতে চাই আমরা। যারা পালিয়ে গেছেন এবং যারা রয়ে গেছেন তাদের সবার সঙ্গে আমরা কথা বলতে চাই। আমি মনে করি রাখাইনে বসবাসকারী মুসলিমদের বিশাল অংশ এই দেশ ছেড়ে যাওয়ার মিছিলে যোগ দেয়নি।

অং সান সুচি আরো বলেন, মুসলিম ও বৌদ্ধ রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সম্প্রীতি ফেরানের জন্য তার সরকার সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিন আরো বললেন, তার উদীয়মান গণতন্ত্র অনেক জটিলতার মুখোমুখি। তার মধ্যে রাখাইন রাজ্য একটি। সুচি বলেন, অনেক সমস্যার মুখোমুখি আমরা। আমরা একটি অল্পবয়সী ও দুর্বল (ফ্রাজিল) দেশ। কিন্তু এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে চাই আমরা। আমরা শুধু কিছু মানুষের দিকে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আটকে রাখতে পারি না।

ওদিকে সিএনএনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় শহর ইয়াঙ্গুন। সেখানে এক ভিন্ন চিত্র। মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নির্বাচিত অং সান সুচি সরকার সেখানে খুব জনপ্রিয়। সেখানে সুচির সমর্থকরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অভিযুক্ত করছেন। তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সংকট যথাযথভাবে অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে। সুচি যখন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন তা দেখার জন্য লাগানো হয় বিশাল স্ক্রিন। সেখানে জমায়েত হন বিপুলসংখ্যক মানুষ। সোমবার এই শহরেই তার প্রতি সমর্থন দেখিয়ে কয়েক শত নেতাকর্মী মিছিল করেছেন। এ সময় কারো হাতের প্ল্যাকার্ডে দেখা যায় শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পাকিস্তানি কিশোরী মালালা ইউসুফজাইয়ের ছবি। তবে স্বাভাবিক নয় তা। সেই ছবিতে মালালার মুখের ওপর ক্রস বা কাটা চিহ্ন দেয়া হয়েছে। এর কারণ, তিনি কয়েকদিন আগে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন অং সান সুচির প্রতি। মালালাকে ব্যবহার করে বানানো পোস্টারে লেখা হয়েছিল ‘শেম অন ইউ’। মালালাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়, যদি তুমি মিয়ানমারের বাস্তব পরিস্থিতি না জানো তাহলে উত্তম হলো চুপ থাকা।

জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে সুচি বলেন, মিয়ানমার একটি জটিল দেশ। যত কম সময়ে সম্ভব সব সমস্যা আমরা সমাধান করে ফেলি মানুষ তাই চায়। আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, এমনকি ১৮ মাস আমাদের সরকার ক্ষমতায় ছিল না। অভ্যন্তরীণ সংঘাতের প্রায় ৭০ বছর পরে আমরা শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জন করেছি। সব রকম মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ওইসব কার্যকলাপ যাতে আইনের শাসন খর্ব হয়েছে তার নিন্দা জানাই আমরা। আন্তর্জাতিক স্ক্রুটিনিতে ভীত নয় মিয়ানমার। রাখাইন রাজ্যে টেকসই সমাধানে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

রাখাইনে সব গ্রুপের মানুষের দুর্ভোগের জন্য গভীরভাবে মর্মাহত মিয়ানমার। মুসলিমরা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে গিয়েছেন তা জানতে পেরে উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
কেন দলে দলে মানুষ দেশ ছেড়ে যাচ্ছে তার কারণ অনুসন্ধান করবো আমরা। যারা পালিয়ে গেছেন তাদের সঙ্গে কথা বলবো। রাখাইনে বসবাসরত সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সম্প্রীতি ফেরাতে সরকার সব রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, এখনও অনেক মুসলিম গ্রামবাসী (রাখাইনে) রয়ে গেছেন। সবাই পালিয়ে যান নি। (পরিস্থিতি দেখতে) আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদস্যদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। (রোহিঙ্গাদের) ফিরে আসায় সহযোগিতা করতে যেকোনো সময় তাদের শরণার্থী মর্যাদা যাচাই করতে প্রস্তুত মিয়ানমার। আমরা রাখাইনে আইনের শাসন বাস্তবায়ন ও উন্নয়নে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করেছি। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ আছে। আমাদের সবার কথা শুনতে হবে। ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে গিয়ে (দোষী) সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সুচি বলেছেন, তিনি (জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব) কফি আনানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন একটি কমিশনের নেতৃত্ব দিতে, যারা রাখাইনে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা সমাধানে আমাদের সাহায্য করবে। তিনি বলেন, গত বছরজুড়ে আমরা আমাদের উন্নয়নমূলক কর্মসূচি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। বিশ্ব যেন আমাদেরকে একটি পূর্ণাঙ্গ দেশ হিসেবে দেখে আমরা এমনটাই প্রত্যাশা করি। তারা যেনো এটাকে দুর্দশাগ্রস্ত হিসেবে না দেখে। আমি বিশ্বাস করি মূল দায়িত্ব হলো এ দেশের জনগণের ওপর। আমরা চাই আমাদের বন্ধুরা আমাদের সঙ্গে যোগ দিন অথবা সহায়তা করুন। আমরা আপনাদের নিরাপত্তা দেবো। আমাদের বিশ্বে যন্ত্রণার সবচেয়ে বড় কারণ হলো ঘৃণা ও আতঙ্ক। আমরা চাই না মিয়ানমারের জাতি ধর্মীয় বিশ্বাস বা জাতিগতভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ুক। সূত্র: মানবজমিন

বিডি২৪লাইভ/আরআই

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: