ভাসমান জলের সবজিতে কৃষকের মুখে হাসি

প্রকাশিত: ০৮ অক্টোবর ২০১৭, ০৪:২৮ পিএম

শরীফ আহমেদ,
চাঁদপুর থেকে:

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলায় জলজ উদ্ভিদ কচুরি পানার মাধ্যমে ভাসমান ব্রেড তৈরি করে সবজি ও মসলা চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষক নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করছেন। উপজেলার কিছু এলাকা বন্যা ও জলাবদ্ধ প্রবণ হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে এ উপজেলার অধিকাংশ নিচু জমি পানির নিচে চলে যায়। তখন কৃষকের কোনো কাজ থাকে না। উপজেলা কৃষি অফিসের আওতায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ভাসমান সবজি ও মসলা উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণ করেছে।

এ উপজেলার কৃষক কচুরিপানা দিয়ে ভাসমান ব্রেড তৈরি করে সবজি ও মসলা চাষ করে বিকল্প আয়ের সংস্থান করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের চাষাবাদের সাথে কৃষক নিজেদের খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন। ব্রেডে সবজিতে সার ও কীটনাশক তেমন ব্যবহার করতে হয় না। বাজারে সুস্বাদু ও নিরাপদ এ সবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ফলে কৃষক এ সবজির বেশি দাম পেয়ে লাভবান হচ্ছেন। বর্ষাকালে এলাকার নিচু জমিসহ ডুবা-নালায় জমে থাকা পানিতে ভাসমান ধাপ পদ্ধতিতে এ চাষাবাদ করা হয়। বর্ষার ভরা মৌসুমে যখন শাক-সবজির আকাল থাকে, তখন এ চাষাবাদে কৃষক পরিবার নিজেদের চাহিদা পূরণসহ উৎপাদিত সবজি বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন বলে জানান তারা।

ডাকাতিয়া নদী অববাহিকার ভাটি অঞ্চল খ্যাত ফরিদগঞ্জের অধিকাংশ এলাকা বর্ষাকালে পানিতে তলিয়ে থাকায় এখানে অধিকহারে এ পদ্ধতিতে চাষাবাদের সম্ভবনা রয়েছে বলে জানায় কৃষি বিভাগ। এছাড়া এ পদ্ধতির চাষাবাদে রাসায়নিক সার ব্যবহার না হওয়ায় বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে এ পদ্ধতি খুবই ইতিবাচক বলে দাবি তাদের। স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শে ও সহায়তায় বেশ কয়েক বছর ধরে ফরিদগঞ্জ বিভিন্ন এলাকার বনভূমিতে বিক্ষিপ্তভাবে এ পদ্ধতিতে সবজির চাষ হচ্ছে বলে জানায় কৃষকসহ সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগ। আর এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে বর্ষা মৌসুমে সবজির আকালের সময়ে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাজারে চড়াদামে বিক্রি করে আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হচ্ছেন বলেও দাবি কৃষকদের। ফলে একের চাষে অন্যে উৎসাহিত হয়ে দিনে দিনে এ পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে এলাকায়।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানাযায়, বর্তমানে সদর এলাকাসহ এ প্রকল্পের আওতায় ১০টি গ্রামে ব্যাপকভাবে ভাসমান ব্রেডে মসলা ও সবজির চাষ করা হয়েছে। উপজেলায় অন্তত ২’শত কৃষক ২০/৩০ ফুট দৈঘ্যের প্রায় পাঁচ হাজার ব্রেড তৈরি করেন সেই খানে ঢেঁড়স, গিমাকলমী, পুঁইশাক, বরবটি, শসা, করলা, ফুলকপি, লালশাক, ডাটাশাক, হলুদ, মরিচ, পেয়াজ, রসুন ইত্যাদি ফসল আবাদ করা হয়। এই উপজেলায় এ বছর প্রায় ৫ একর জমিতে এই ভাসমান ব্রেড তৈরি করা হয়েছে।

উপজেলার সোবাহান গ্রামের কৃষক আলমগীর হোসেন বলেন, আমি আজ ১৫ বছর থেকেই কচুরির ধাপে ভাসমান ব্রেড চাষ শুরু করে থাকি। সনাতন এ পদ্ধতিতে চাষাবাদে লাভ হতো না। তাই আমাদের কে কৃষি অফিসারেরা কিভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করে ভাসমান সবজি ও মসলা উৎপাদ করার যায় সেই বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। আমরা সেই প্রশিক্ষন নিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কচুরি পেনার ধাপে ব্রেডে চাষাবাদ করে লাভবান হচ্ছি। মাটিবিহীন এসব চাষাবাদ দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ছুটে আসছেন।

সোবহান গ্রামের কৃষকরা জানান, এক শতাংশ পরিমাণ ধাপ তৈরি করতে আমাদের প্রায় ৪ হাজার টাকা খরচ হয়। আর আয় হয় প্রায় ৮০০০ টাকা। খরচ বাদে প্রতি শতক ব্রেডে থেকে লাভ থাকে ৪ হাজার টাকা। ভাসমান ব্রেডে সবজি উৎপাদন শেষে ওই ব্রেডকে ভেঙ্গে জমিতে ছড়িয়ে দিয়ে আমরা জৈবসার হিসেবে ব্যবহার করি। শীত মৌসুমে ব্রেডের বদৌলতে বিনা চাষে ও রাসায়নিকমুক্ত সবজি উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছি।

কৃষক শহিদ উল্যাহ বলেন, আমি এ বছর ৫০টি ভাসমান ধাপ তৈরি করি। এ থেকে আমি প্রায় ২ লাখ টাকা আয় করতে পারব বলে আশা করছি। ভাসমান সবজি চাষ আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছে। আমরা কৃষি বিভাগের পরামর্শে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার ছাড়াই আধুনিক পদ্ধতিতে ধাপে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করছি। বাজারে এ সবজির চাহিদা ও দাম বেশি। বেশি দামে সবজি বিক্রি করে আমরা লাভবান হচ্ছি।

ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদরের উপ-সহকারী কৃষি অফিসার নুরে আলম বলেন, প্রতি বছরই ফরিদগঞ্জ ভাসমান ধাপে সবজি ও মসলা আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশপাশের অন্য উপজেলায় বীজতলা, সবজির চারা উৎপাদন অন্য কাজে কচুরিপানার ধাপকে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ভাসমান চাষাবাদ পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে। কৃষকের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে। শীতের সবজি উৎপাদনে ধাপকে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নিম্নাঞ্চলের কৃষকদের কচুরিপানা দিয়ে ভাসমান সবজি চাষ একটি চমৎকার সমাধান। প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা বাড়িয়ে সবজি ও মসলার উৎপাদন প্রায় ৫ থেকে ৬ গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। পদ্ধতির আবাদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে। এখানে উৎপাদিত শাক-সবজি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে পাশভর্তি এলাকা রায়পুর,চাঁদপুর সদর সহ বিক্রি করা হচ্ছে। লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছর এখানে এ পদ্ধতির সবজি আবাদ সম্প্রসারিত করা হলে বর্ষাকালে সবজির সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব।

বিডি২৪লাইভ/এস এ

 

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: