‘প্রতিদিনই মেরে ফেলার ভয় দেখানো হতো, ভাবিনি বেঁচে ফিরব’
কখনো সিগারেটের আগুনের ছেঁকা, কখনো প্লাস্টিকের পাইপে আগুনের তাপ দিয়ে ঝলসানো হতো শরীর। বিরতি দিয়ে চলত মারধর। স্বজনদের ফোন করে শোনানো হতো যন্ত্রণার আর্তচিৎকার। বাঙালি ও লিবীয় অপহরণ সিন্ডিকেটের হাত থেকে গত ১৩ ডিসেম্বর মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে ভয়ংকর জিম্মিদশার এমন বর্ণনাই দিয়েছেন দুই যুবক। তবে এখনো লিবিয়ায় বাংলাদেশের অনেকে জিম্মি রয়েছে বলে জানায় পুলিশ।
রুবেল প্রামাণিক ও মমিনুল ইসলাম নামের দুজন আদালতে জবানবন্দি দিয়ে এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সংঘবদ্ধ অপরাধ দলের তৎপরতায় ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ও মাইগ্রেশনের (আইওএম) সহযোগিতায় উদ্ধার করে তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। সিআইডি অপহরণকারী সিন্ডিকেটের ১১ সহযোগীকে বাংলাদেশে গ্রেপ্তার করেছে। আর লিবিয়ায় গ্রেপ্তারকৃত সিলেটের ফজলুল হক এবং দুই লিবিয়ানের সে দেশের আইনানুযায়ী ২০ বছরের সাজা হয়েছে।
সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ দলের বিশেষ পুলিশ সুপার (এস এস) মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, রুবেল ও মমিনুলকে উদ্ধারের পর আমরা জানতে পেরেছি যে লিবিয়ায় এখনো অনেক বাঙালি অপহৃত হয়ে আছে। তাদের উদ্ধারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে জিম্মিকারীরা ঘন ঘন হাত বদল করার কারণে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করতে কিছুটা সময় লাগছে বলে জানান তিনি।
মমিনুল ইসলাম জানান, তিনি তিন মাস জিম্মি থাকার পর দেশে ফিরতে পেরেছেন। তাঁর বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানার কাশিমারি গ্রামে। আর্থিক সচ্ছলতার আশায় ২০১২ সালে লিবিয়া যান কোরআনে হাফেজ মমিনুল। সেখানে তিনি লিবিয়া সেনাবাহিনীর মসজিদে ইমামতি করতেন। পাশাপাশি স্থানীয় একটি হাসপাতালেও কাজ করতেন।
এক বছর পর সেখানে টাঙ্গাইলের সারোয়ার নামের এক যুবকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও পরে বন্ধুত্ব হয়। ২০১৬ সালের জুলাই মাসের এক সকালে সরোয়ার ফোন করে মমিনুলকে বলেন, তিনি দেশে যাচ্ছেন, মমিনুলের সঙ্গে জরুরি কিছু কথা আছে। দেখা করতে মমিনুল তাঁর বাসার গেটে গিয়ে দেখেন কালো রঙের একটি গাড়ি। গাড়ির ভেতরে সারোয়ারসহ চারজন বাংলাদেশি ও দুজন লিবিয়ান বসে রয়েছে। কাছে যেতেই দুই লিবিয়ান জোরপূর্বক মমিনুলকে গাড়িতে তুলে নেয়। এক দিন পর মমিনুলকে দিয়ে তার পরিবারকে ফোন করানো হয়। বলা হয়, ১০ লাখ টাকা না দিলে মমিনুলকে মেরে ফেলা হবে।
মমিনুল বলেন, ‘প্রতিদিনই মেরে ফেলার ভয় দেখানো হতো। ভাবিনি বেঁচে ফিরব। সন্তানকে জীবিত ফেরত পেতে জমি বিক্রি করে এক সপ্তাহের মধ্যে বিকাশের মাধ্যমে আট লাখ টাকা পাঠান তাঁর বাবা। এর মধ্যে টাঙ্গাইলে সারোয়ারের স্ত্রী ও শ্বশুরের কাছে পাঁচ লাখ, ফজলু নামের ওই চক্রের আরেক সদস্যের চাচার কাছে সিলেটে দুই লাখ এবং ভৈরবের দুই ভাইয়ের কাছে আরো এক লাখ টাকা পাঠানো হয়। আট লাখ টাকা পাওয়ার পর শুরু হয় নতুন নির্যাতন। দ্বিতীয় দফায় দাবি করা হয় ৫০ লাখ টাকা। এবার মমিনুলের পরিবার সাতক্ষীরা থানায় মামলা করে তদন্তে নামে সিআইডি। বিকাশে অর্থ পাঠানোর সূত্র ধরে টাঙ্গাইল থেকে সারোয়ারের স্ত্রীসহ দুজন, সিলেট থেকে একজন এবং ভৈরব থেকে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মুক্তিলাভের নেপথ্য কাহিনীর বিবরণ দিয়ে মমিনুল বলেন, নির্ধারিত সময়ে টাকা না দেওয়ায় মমিনুলকে হত্যা করার জন্য নেওয়া হয় সমুদ্র পাড়ে। তখন সারোয়ার জিম্মিচক্রের লিবিয়ান সদস্যদের পা ধরে বলেন, তাঁর বউ এবং শ্বশুরকে দেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই অবস্থায় মমিনুলকে হত্যা করলে তাঁরা মুক্তি পাবেন না। মমিনুলের লিবিয়ায় অবস্থান করা বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাকি টাকা জোগাড় করে দেওয়ার বিষয়েও আশ্বস্ত করেন সারোয়ার।
মমিনুল ও সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, লিবিয়ার হাসান সাত লাখ টাকা দেন সারোয়ারকে। বাকি চার লাখ টাকা দেওয়ার জন্য আরো এক সপ্তাহ সময় নেন। পরে মমিনুলের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে হাসান বাকি টাকা সংগ্রহ করে খবরটি সারোয়ারকে দেন। তখন তাঁদের মধ্যে চুক্তি হয়—এক হাতে টাকা আরেক হাতে মমিনুল। চুক্তি অনুযায়ী, সারোয়ার ও লিবিয়ান অপহরণকারীরা দুটি গাড়ি নিয়ে নির্ধারিত স্থানে যায়। এর মধ্যে বিষয়টি সিআইডির পক্ষ থেকে লিবিয়া পুলিশকেও জানানো হয়েছিল। তারা ওত পেতে থাকে। হাসানের হাত থেকে অর্থ নেওয়ার মুহূর্তে লিবিয়ার পুলিশ জিম্মিকারী ফজলু ও দুই লিবিয়ানকে গ্রেপ্তার করে। মমিনুলকে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ও মাইগ্রেশনের (আইওএম) সহযোগিতায় দেশে ফিরিয়ে আনে সিআইডি। আর সিলেটের ফজলুসহ দুই লিবিয়ানের ওই দেশের আইনানুযায়ী ২০ বছরের সাজা হয়।
মমিনুল বলেন, বাঙালিরাই বাঙালিদের তুলে দিচ্ছে জিম্মিকারীদের হাতে। পরে অর্থ আদায়ও করে বাঙালিরা। লিবিয়ানরা শুধু তুলে নিয়ে যাওয়া এবং জিম্মি করে রাখার কাজটি করে।
জিম্মি থাকা রুবেল প্রামাণিক বগুড়ার শিবগঞ্জ থানার শৌলা নারায়ণপুর গ্রামের সাহেব আলী প্রামাণিকের ছেলে। লিবিয়ায় গিয়ে তিনি বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। সেই কাজের সুবাধেই সেলিম নামের এক বাংলাদেশির সঙ্গে ঘনিষ্ঠাতা হয় তাঁর। একদিন তাঁকে ঘুরতে নিয়ে যান সেলিম এবং কৌশলে লিবিয়ানদের হাতে তুলে দেন। রুবেলের ওপরও চলে নির্মম নির্যাতন। চার হাত ঘুরে তাঁকেও দিতে হয় আট লাখ টাকা। শেষ জিম্মিকারী দলটি অর্থ পেয়ে ছেড়ে দেয় রুবেলকে। পরবর্তী সময়ে রুবেলের পরিবারও সিআইডির সহায়তা নিয়ে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনে। সূত্র: কালেরকণ্ঠ
বিডি২৪লাইভ/এএইচআর
বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
মার্কেটিং ও সেলসঃ ০৯৬১১১২০৬১২
ইমেইলঃ [email protected]
পাঠকের মন্তব্য: