দ্বন্দ্ব নিরসনে যে কৌশলে এগোচ্ছে আ’লীগ

প্রকাশিত: ২২ জানুয়ারি ২০১৮, ০১:২৫ পিএম

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের এখনও বছরখানেক বাকি আছে। তবে এরই মধ্যে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে। বিজয় নিশ্চিত করে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করার লক্ষ্য নিয়ে দলকে প্রস্তুত করার কাজে নামছেন দলটির নেতারা।

এ মাসের ২৬ জানুয়ারি থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত ১৫টি টিম সারা দেশে জেলা-উপজেলায় সাংগঠনিক সফর শুরু করবে। উঠান বৈঠক থেকে শুরু করে বর্ধিত সভা, কর্মিসভা, পথসভা ও জনসভা করার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামছেন নেতারা। তাদের লক্ষ্য দীর্ঘদিন ধরে দলের মধ্যে চলা দ্বন্দ্ব, কলহ-বিবাদ নিরসন; দলে বিরোধীদের চিহ্নিতকরণ; দলের চেইন অব কমান্ড মজবুত এবং সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করা।

এছাড়া বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও জনগণের সামনে তুলে ধরা এবং খাতওয়ারি সরকারের উন্নয়নগুলো জনগণের সামনে উপস্থাপন করে সরকারের ধারাবাহিকতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা। দলীয় নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে বিভাগীয় শহরগুলোয় জনসভায় অংশ নেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এসব কর্মসূচির তারিখ ও ধরন জানানোর জন্য রোববার জেলার নেতাদের কাছে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে একটি চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। ২৬ তারিখের মধ্যে তা দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকের মাধ্যমে কেন্দ্রকে জানাতে বলা হয়েছে বলে দপ্তর সূত্র নিশ্চিত করেছে।

একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৮ সালকে নির্বাচনের বছর হিসেবে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সিটি ও জাতীয় নির্বাচনের জন্য দেশের সর্ববৃহৎ ও প্রাচীন এই রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনমুখী করে তোলার জন্য এক বছর সময় খুব বেশি নয়। তাই এ বছরের শুরু থেকেই নির্বাচনি মিশন শুরু করার পরিকল্পনা নিয়ে অভ্যন্তরীণ কাজ চলিয়ে যাচ্ছেন দলটির নেতারা।

বছরের শুরুতে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে ১৫টি টিম করার পর এখন জেলার নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জেলা সফর সময়সূচি ঠিক করা হচ্ছে। গত শনিবার নাটোর ও জয়পুরহাট জেলার নেতাদের নিয়ে বসেন কেন্দ্রীয় নেতারা। সংগঠনের মধ্যে চলা দ্বন্দ্ব ও সমস্যা মিটিয়ে নিতে জেলার নেতাদের প্রতি কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন তারা।

মূলত বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদককে জেলার নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারিখ চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রোববার দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি চিঠি জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের উদ্দেশে পাঠানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ঘোষিত সাংগঠনিক সফরের জন্য কখন ও কী ধরনের কর্মসূচি নেওয়া হবে তা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম ও সাংগঠনিক সম্পাদকের মাধ্যমে কেন্দ্রকে জানাতে হবে। ২৬ জানুয়ারির মধ্যে কর্মসূচি পাঠাতে বলা হয়েছে।

এখন পর্যন্ত ২৭ জানুয়ারি বান্দরবান ও নাটোরে জনসভার তারিখ চূড়ান্ত হয়েছে বলে দলের একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা নিশ্চিত করেছেন। এদিকে জানুয়ারির শেষ অথবা ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে মার্চের মধ্যে সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল ও খুলনা সিটিতে নির্বাচনি জনসভা করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সিলেট হজরত শাহজালাল (রহ.) এর মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে নির্বাচনি সফর শুরু হবে বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, আগামী নির্বাচনে জয়ের লক্ষ্য সামনে রেখে দলকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এজন্য আগে আমরা বিভিন্ন এলাকায় দলের মধ্যে যে বিভাজন রয়েছে, নেতাদের মধ্যে রেষারেষি আছে। এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মীদের দুরত্ব রয়েছে এগুলো ঠিক করা।

এ কাজে আমরা জেলা-উপজেলা এবং এর চেয়েও তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের মতামত নেব। তাদের কথা শুনব। এর ভিত্তিতে সমাধানের মাধ্যমে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করব। ৩০০ আসনেই কাজ হবে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, যেসব জায়গায় দলীয় প্রার্থী জয়ের সম্ভাবনা বেশি; আওয়ামী লীগের অবস্থান ভালো; সেসব জায়গায় বেশি নজর দেওয়া হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, এবার আওয়ামী লীগ ২০০ আসনে জয়ের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করবে। দলগতভাবে এ সংখ্যা ১৭০ থেকে ১৭৫টি হবে। বাকিটা শরিক ও অন্যদের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে অর্জন করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি, ১৪ দল ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের বাইরের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতা হতে পারে বলেও আভাস দেন তিনি।

জেলা সফরের বিষয়ে আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি বলেন, কর্মিসভা থেকে শুরু করে নানা ধরনের কর্মসূচির মাধ্যমে দলকে আমরা আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করব। এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলার নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তাদের সুবিধামতো সময় কখন সেটা জানতে চাওয়া হচ্ছে। এর পরে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমরা জেলা সফরের তারিখ ঠিক করব; দলীয় সভাপতি তা চূড়ান্ত করবেন।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম বলেন, আগামী নির্বাচনে জয়ের লক্ষ্যে এ জেলা সফরে আমরা দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনকে বেশি প্রাধান্য দেব। জেলা-উপজেলায় বর্ধিত সভা, কর্মিসভা, বিভাগীয় সভা এবং জনসভা করে নৌকা মার্কায় ভোট চাইব।

পাশাপাশি নির্বাচন সামনে রেখে সাংগঠনিক কাজ কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি, পোলিং এজেন্টদের লিস্ট তৈরি করা, নতুন ভোটার নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে সারা দেশে একটি নির্বাচনি আবহ তৈরি করে দলকে প্রস্তুত করা হবে। পাশাপাশি সরকারের উন্নয়নের চিত্র ও প্রকারান্তরে বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াওয়ের চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরে আওয়ামী লীগের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করাই হবে আমাদের কাজ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে।

দলীয় একটি সূত্র জানায়, ১২ জানুয়ারি রংপুর বিভাগে শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ কর্যক্রমে অংশ নিয়ে বিভাগের দলীয় নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি রংপুর বিভাগের সাংগঠনিক জেলাগুলোর সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এখন থেকেই আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেন। এ সময় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রতি ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি দলে নতুন সদস্য সংগ্রহ ও নতুন ভোটারদের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে দলকে নির্বাচনমুখী করে তোলার পরামর্শ দেন তিনি। একই বার্তা সারা দেশে সাংগঠনিক জেলা-উপজেলা কমিটিগুলোকেও দেওয়া হবে।

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সাংগঠনিক সফরে করণীয় নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি সফর নিয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। প্রয়োজনে একই এলাকায় দফায় দফায় সাংগঠনিক সফর করার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। সম্পাদকম-লীর কয়েকজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মূলত প্রধানমন্ত্রী দলের দ্বন্দ্ব ও সমস্যা সমাধান করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন।

বর্তমান এমপিদের এলাকায় জনপ্রিয়তা যাচাই করার পাশাপাশি সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা, দলের মধ্যে অবস্থান ও তাদের কর্মকা- পর্যবেক্ষণের পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া যারা নিজেদের স্বার্থে অপপ্রচার চালাতে গিয়ে দলের ক্ষতি করছেন; তাদের তালিকা করা ও সাবধান করে দেওয়া; কোনো ব্যক্তি নয়, শুধু নৌকার পক্ষে প্রচারণা চালানোর নির্দেশ দেওয়া; এরই সঙ্গে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থান ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের অবস্থান নিয়েও খোঁজখবর নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার এসব দিকনির্দেশনা কার্যকর করবেন সাংগঠনিক সফরে যাওয়া কেন্দ্রীয় নেতারা। এর মধ্য দিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের প্রকৃত সাংগঠনিক চিত্র উঠে আসবে বলেও মনে করেন দলটির হাইকমান্ড। সাংগঠনিক এ সফর শেষ হওয়ার পর প্রতিটি টিমের প্রধানরা তৃণমূল পর্যায়ে দলের সর্বশেষ অবস্থান তুলে ধরে লিখিত প্রতিবেদন দেবেন।

বিডি২৪লাইভ/এএইচআর

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: