সু চির বিরুদ্ধে মামলার আবেদন

প্রকাশিত: ১৮ মার্চ ২০১৮, ১২:১৪ এএম

অং সান সু চি  একজন বর্মী রাজনীতিক, কূটনীতিক, এবং লেখিকা যিনি মায়ানমারের প্রথম ও বর্তমান রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা এবং ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির নেত্রী। মায়ানমারের ডি ফ্যাক্টো তথা অনানুষ্ঠানিক প্রধান হিসেবেই তিনি ব্যাপকভাবে পরিচিত।

এছাড়াও প্রথম নারী হিসেবে তিনি মায়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের মন্ত্রী, বিদ্যুৎশক্তি ও ক্ষমতা বিষয়ক মন্ত্রী, এবং শিক্ষা মন্ত্রী হিসেবে প্রেসিডেন্ট টিন চাঅয়ের কেবিনেটে কাজ করেন; আর ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি মায়ানমারের হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস তথা নিম্নকক্ষে কৌমু টাউনশিপের এমপি ছিলেন।

আধুনিক মায়ানমারের জাতির জনক অং সান এবং খিন চির কন্যা সু চির জন্ম হয় ব্রিটিশ বার্মার রেঙ্গুনে।

১৯৬৪ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৯৬৮-তে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক অর্জন করার পর তিনি জাতিসংঘে তিন বছর কাজ করেন। ১৯৭২ সালে মাইকেল অ্যারিসকে বিয়ে করেন এবং তাদের দুই ছেলে হয়। ১৯৮৮-র গণআন্দোলনের সময় সু চি সবার নজর কাড়েন এবং ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) সাধারণ সম্পাদক হন; সেসময় সদ্যগঠিত দলটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সামরিক জান্তার বিরোধী অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা।

১৯৯০ সালের নির্বাচনে এনএলডি সংসদের ৮১% আসন পেলেও সেনাবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায় যা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হৈ চৈ ফেলে দেয়। এদিকে নির্বাচনের আগে থেকেই সু চিকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ২১ বছরের মধ্যে ১৫ বছরই তাকে গৃহবন্দী অবস্থায় কাটাতে হয়; ততদিনে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে প্রখ্যাত রাজবন্দীদের একজন হয়ে উঠেছেন।

সু চির দল ২০১০ সালের নির্বাচন বয়কট করে, যা সেনাসমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে তাৎপর্যপূর্ণ বিজয় এনে দেয়। ২০১২ সালের উপনির্বাচনে সু চি সংসদের নিম্নকক্ষের এমপি হন এবং তার দল ৪৫টি ফাঁকা আসনের মধ্যে ৪৩টিতে জয়লাভ করে। ২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনে তার দল ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করে, অ্যাসেমব্লি অব দি ইউনিয়নের (সংসদ) ৮৬% আসন অর্জন করে; যদিও প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকটোরাল কলেজে তাদের প্রার্থীকে রাষ্ট্রপতি ও দ্বিতীয় উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচনের জন্য ৬৭% সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যথেষ্ট ছিল।

সু চির প্রয়াত স্বামী ও সন্তানেরা বিদেশি নাগরিক হওয়ায় সংবিধান অনুসারে তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না; তাই তিনি নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা পদটি গ্রহণ করেন যা কিনা প্রধানমন্ত্রী বা সরকারপ্রধানের সমান। গণতন্ত্র ও মানবতার পক্ষে সংগ্রামের জন্য তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার (১৯৯১) সহ আরো অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন, যদিও রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গে তার ভূমিকা তীব্রভাবে সমালোচিত।

সম্প্রতি, অং সান সু চিকে সরাসরি দায়ী করে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা দায়েরের জন্য আবেদন করেছেন অস্ট্রেলিয়ার কয়েকজন আইনজীবী। শুক্রবার (১৬ মার্চ) মেলবোর্নের একটি বিচারিক আদালতে আইনজীবীরা এই আবেদন করেন।

সু চি’র বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা দায়েরের জন্য যারা আবেদন করেছেন, তারা হলেন,  মেলবোর্নের ব্যারিস্টার রন মের্কেল কিউসি, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ম্যারিয়ন আইসোবেল, রায়েলিন শার্প, সিডনির মানবাধিকার আইনজীবী অ্যালিসন ব্যাটিসন ও ড্যানিয়েল টেইলর।

মেলবোর্নের আদালত আবেদনটি মূল্যায়ন করেছেন। আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন আদালত।

অস্ট্রেলিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ক্রিশ্চিয়ান পোর্টারের কাছে বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করার অনুমতি চেয়ে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানানো হয়েছে। আইনজীবীদের আবেদনের ভিত্তিতে সু চি’র বিরুদ্ধে মামলাটি শুরু করতে হলে অ্যাটর্নি জেনারেলের অনুমোদন প্রয়োজন।

মামলার আবেদনপত্রে সু চি’র বিরুদ্ধে মিয়ানমারের একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর (রোহিঙ্গা) বিরুদ্ধে মানবতা লঙ্ঘনকারী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তাদেরকে জোরপূর্বক নিজ বাসভূমি থেকে সরিয়ে দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ ও জ্বালাও পোড়াও থেকে বাঁচতে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে।

এ ব্যাপারটি স্বীকার করে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের সমর্থন করার অভিযোগে এই মামলা করতে চাইছেন মেলবোর্নের ওই আইনজীবীরা।

এই সপ্তাহে সু চি অস্ট্রেলিয়ায় আসিয়ানের একটি বিশেষ সম্মেলনে যোগ দিতে ১৭ মার্চ সিডনি পৌঁছানোর কথা। ১৭ ও ১৮ মার্চ সিডনিতে আসিয়ান-অস্ট্রেলিয়া শীর্ষক বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

আসিয়ানভুক্ত দশ দেশের নেতাদের সঙ্গে এই সম্মেলনে থাকবেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল।

অস্ট্রেলিয়া আন্তর্জাতিক বিচারিক ক্ষেত্রের (ইউনিভার্সেল জুরিসডিকশন) নীতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর ফলে দেশটির আদালতে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে যেকোনও দেশের নাগরিকের বিরুদ্ধে শুনানি হতে পারে।

এর আগে এ ধরনের একটি বিচারের আন্তর্জাতিক উদাহরণ রয়েছে। চিলির সাবেক স্বৈরশাসক অগাস্টো পিনোশেটকে লন্ডনে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাকে গৃহবন্দি করা হলেও বিচার করা হয়নি।

এক্ষেত্রে বিদেশি নেতাদের বিচারের ক্ষেত্রে কূটনৈতিক দিকও বিবেচনা করা হয়। ফলে সু চির বিরুদ্ধে মামলাটি অ্যাটর্নি জেনারেলের অনুমতি ছাড়া শুরু করা যাবে না। অস্ট্রেলিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেলের এক মুখপাত্র গার্ডিয়ানকে জানিয়েছেন, ‘আমরা এ ধরনের কোনও পদক্ষেপের বিষয়ে অবগত নই, অবগত হলেও আদালতের কোনও বিষয় নিয়ে আমরা মন্তব্য করবো না।’ এছাড়া সু চি’র কূটনৈতিক দায়মুক্তির কারণেও বিচারের মুখোমুখি হওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারেন।

গত বছরের ২৫ আগস্ট নিরাপত্তা চৌকিতে আরসার হামলাকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের কারণ বলা হলেও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিতে এবং তাদের ফেরার সমস্ত পথ বন্ধ করতে আরসার হামলার আগে থেকেই পরিকল্পিত সেনা-অভিযান শুরু হয়েছিল। চলমান জাতিগত নিধনে হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭ লাখ মানুষ। তারা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে।

বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এ ঘটনায় খুঁজে পেয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এই ঘটনাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ আখ্যা দিয়েছে। রাখাইন সহিংসতাকে জাতিগত নিধন আখ্যা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ। তবে এইসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।

সু চি প্রথম থেকেই এসব অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করে এসেছেন। আর যখন পরোক্ষভাবে কিছু অভিযোগ স্বীকার করেছেন, সেখানেও পক্ষ নিয়েছেন সেনাবাহিনীরই।

অং সান সু চি তার অবস্থান ও ক্ষমতা ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং এ কারণেই মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীকে তিনি রোহিঙ্গাদের আবাস থেকে উৎখাত করার অনুমতি দিয়েছেন – এই অভিযোগ থেকে মামলার আবেদন করা হয়েছে।

বিডি২৪লাইভ/এইচকে

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: