‘আদরের বোন অহনা জানেন না ভাই মারা গেছেন’

প্রকাশিত: ২৬ এপ্রিল ২০১৮, ১২:৪৩ পিএম

রাজীব হোসেন। পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানার দাসপাড়া গ্রামে নানা বাড়িতে ১৯৯৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মা-বাবার সাথে বরিশালে ছিলেন। যদিও তার বাবার বাড়ি ছিল বাউফলের ইন্দুকোল গ্রামে। মেহেদী হাসান ও আব্দুল্লাহ নামের আরও দুই ভাই আছে।

বাবা হেলাল উদ্দিন অপসোনিন ফার্মাসিউটিক্যাল ওষুধ কোম্পানীতে চাকরী করতেন। সেই সুবাদে তারা বরিশালের বগুড়া রোডে একটি ভাড়া বাসা থাকতেন। তিনি বরিশালের উদয়ন স্কুলে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন। হঠাৎ করে হাইপ্রেসারের কারণে তার মা আকলিমা আক্তার মারা যান।

তখন তার বয়স সবে মাত্র ৭ বছর। চাকুরি আর তিন সন্তান নিয়ে কষ্টের মধ্যে দিন পার করতে লাগলেন রাজীবের বাবা। তিন সন্তানকে লালন পালনে সমস্যা হয় বিধায় নানার বাড়ি পাঠিয়ে দেন। রাজীব হোসেন ও তার দুই ভাই নানার বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। বাবাও তাদেরকে দেখতে কয়েকদিন পরপরই চলে যেতেন।

রাজীব হোসেন বাউফল বকুলতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আবার চতুর্থ শ্রেনীতে ভর্তি হন। এই বিদ্যালয়টির পুরাতন নাম পরিবর্তন করে বর্তমানে বাউফল মডেল সরকারি বিদ্যালয় রাখা হয়েছে। এই স্কুল থেকে সে পঞ্চম শ্রেনীতে পরীক্ষা দেন। তারপর সে বাউফল উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে ভর্তি হন। এই বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করার সুযোগ হয়েছিল তার।

অফিসের কাজ চট্রগ্রাম যান তার বাবা হেলাল উদ্দিন। তিনি কর্মরত অবস্থায় সেখানেই স্ট্রোক করে মারা যান। তার বছর খানেক আগে মেয়ের শোকে মারা যান নানী। বাবার মৃতুর পর চাঞ্চল্যকর ছেলেটি হয়ে যায় একেবারে চুপচাপ। দুই ভাইকে হাফেজি মাদরাসা ভর্তি করান এবং ঢাকার খালার বাসায় চলে আসেন। তাদের দায়িত্ব নিয়ে ছিলেন তিন খালা আর দুই মামা।

২০১০ সালে তাকে মতিঝিল পোষ্ট অফিস হাইস্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি করি দেন খালা জাহানারা বেগম। সময় বাড়ার সাথে তার চুপসে যাওয়াটা যেন বাড়তে থাকে। স্কুল থেকে ফিরেই বাসায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকতেন। কী হয়েছে প্রশ্ন করলেই কিছু হয়নি বলে হাসি দিতেন।

এই বিদ্যালয় থেকে ২০১২ সালে এসএসসি পাশ করেন। সেই পরীক্ষায় তিনি ৪.১৩ জিপিএ পেয়েছিল। তারপরই সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজে ভর্তি একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হলেন। সেখান থেকে ৪.১০ নিয়ে এইচএসসি পাশ করেন ২০১৪ সালে। ২০১৫-১৬ সেশনে তিতুমীর কলেজে ডিগ্রীতে ভর্তি হলেন।

তখন খালার বাসা থেকে চলে যান এবং যাত্রাবাড়িতে একটি মেসে উঠেন। ছোট বেলা মা-বাবাকে হারিয়ে প্রথম বারের মতো আত্মীয়দের থেকে দূরে সরে আসলেন। কিন্তু পাশে ছিলো দুই ভাই। ভাইদের শিক্ষিত করতে হাফেজ হওয়ার পর তামিরুল মিল্লাতমাদরাসা ভর্তি করে।

সারাদিন সে ৪টি টিউশনি করাতেন। এইচএসসির পরই সে এই টিউশনিগুলো শুরু করেন। মেসের ভাড়া, খাবার খরচ, ভাইদের পড়াশোনার খরচ যোগাতে রাত দিন পরিশ্রম করতেন।

তার খালা-খালুরাও কিছু সহযোগিতা করতেন। নিজে কোনো হাত খরচ করতে না। ভাইদেরকে শিক্ষিত করার জন্য বড় ভাই হয়েও বাবার ভূমিকা পালন করতেন।

এই থেকে শুরু হয় জীবন যুদ্ধ। তাছাড়া তিনি ২০১৫-১৬ সেশনে বরিশাল সরকারি ফজলুল হক কলেজে অর্নাসে ভর্তি হন। সেখানে তিনি ইংরেজী বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল। তার কলেজ রোল ছিল -১১২৯।

অর্নাসে কেন প্রশ্নে জবাবে জাহানারা বেগম কান্না কণ্ঠে বলেন, ‘রাজীবের ইচ্ছা ছিল অর্নাসে পড়ে বিসিএস পরীক্ষা দেওয়া। তাই ২০টি মতো সরকারী চাকরীতে আবেদন করেছে।’ তাছাড়া রোজগার করার জন্য আইডিয়াল অনলাইন কম্পিউটার সেন্টারে প্রশিক্ষণ নিয়ে ছিলেন। শিখেই যাত্রাবাড়িতে একটি দোকানে বিকালে রাতে টাইপিংয়ের কাজ করতেন। রাতেও নিজের বাসায় কাজ করতেন। তবে অভাবের মধ্যে থাকলেও তার শখ ছিলো অন্যরকম।

সে লুঙ্গি পড়তে পারতেন না। তার জন্য খালা-খালুর কাছ থেকে কত শত বকা খেয়ে ছিলেন তা নজীরবিহীন। প্যান্ট আর গেঞ্জি তার পছন্দের কাপড় ছিল। তাকে অবশ্য কাপড় কিনতে হতো না। খালু বায়িং হাউজে কাজ করার সুবাদে তার কোনো কাপড়ের অভাব ছিলো না। খালা বলেন, ‘রাজীবের মৃত্যুর একদিন আগে ছোট খালা হ্যাপী বেগমের কাছে হাসপাতালে কেঁদে কেঁদে বলে ছিলেন, কোনো দিনও প্রাইভেট পড়লাম না, নিজে নিজে পড়েছি। ইংরেজী গ্রামার ভালো ভাবে পড়তে পারিনি। কারো কাছে গেলে এক সময় বুঝিয়ে দিতেন আনেক সময় দিতেন না। নিজে নিজেই পড়েছি। ভালো ভাবে পড়তে পারিনি। তাহলে চাকরি হবে কী করে?’

রাজীব হোসেন হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর মাত্র কয়েক চামচ জুস ও স্যুপ খেয়ে ছিলেন। কিন্তু সেই রাজীব গরু মাংস পেলেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেতে। গরুর মাংস তার প্রিয় খাবার ছিলো। তাছাড়া মাছের লেজ ছিল প্রিয়। সবাই লেজ খাওয়া নিয়ে হাসাহাসি করলেও সে লেজ খেতেই পছন্দ করতেন।
বাসায় ভালো রান্না হলে ফোন করে তাকে নিয়ে আসতেন খালা। তাছাড়া কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানের দাওয়াত পেলে তাকে নিয়ে যেতেন। রাজীব ও তার দুই ভাই এমনই ভালো ছেলে ছিলেন যে, তাদের সঙ্গে কারো কোনো দিন ঝগড়া হয়নি।

রাজিব দিনরাত পরিশ্রম করে ১০/১১ হাজার টাকা পেলেও তার চালচলন ছিল রাজা-বাদশাদের মতো। কাপড়ের ক্ষেত্রে সে কালো রং কে বেশি প্রাধান্য দিত। সেই কালো রংয়ের গেঞ্জি পড়েই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

শত অভাবের মধ্যেও নিজে না খেয়ে ভাইদেরকে খাওয়াত। রাজীব স্কুলে পড়া অবস্থায় ক্রিকেট খেলাকে পছন্দ করত। কিন্তু দূরে গিয়ে খেলত না। ক্যারাম ও ভালো খেলতে পারত রাজিব। বিকালে সময় পেলে ঘরে বসে থাকত কিন্তু বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিত না।

জাহানারা বেগম ডাক অধিদপ্তরের সেকশন সহকারি হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি স্বামী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে সাথে নিয়ে মতিঝিল টিএন্ডটি কলোনীতে বসবাস করছেন। রাজীবের সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে খালা জাহানারা বেগমের।

স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, দুঘর্টনার আগের দিন বাসা পরিবর্তন করেন তিনি। পুরাতন বাসা থেকে নতুন বাসায় ভ্যানগাড়ি দিয়ে মালামাল আনছিলেন। তখন রাজিব একটি ওয়ারড্রব একাই মাথা করে নিয়ে আসেন। এনেই হাত-পা ছেড়ে দিয়ে খাটের উপর শুয়ে পড়েন।

তখন খালু জাহানারা কে ডেকে বলে দেখো আমাদের রাজীব কত বড় হয়ে গেছে। সে শুয়ে ছিল মৃত ব্যাক্তির মতো। ঘামে দেখতে ফ্যাকাশ হয়ে গেছিল। জাহানারা প্রথমে দেখে ভয় পেয়ে গেছিলেন। চিৎকার দিয়ে বলেও উঠে ছিলেন ‘কী হয়েছে রাজীব ?’

এছাড়া তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হাজরো স্মৃতি। তিনি কেঁদে কেঁদে বলেন, একদি পোষ্ট অফিস হাইস্কুল থেকে খবর দেয় রাজীব দুই ধরে স্কুলে যায় না। সেই তাকে ধরে স্কুলে নিয়ে গণিতের শিক্ষককে বলে ছিলাম ‘তার মাংস আপনার আর হাড়গুলো আমাকে দিবেন, যাতে আর কোন দিন স্কুল বন্ধ করতে না পারে। সেই শিক্ষক তাকে অনেক মেরে ছিলেন। সেই মারার কারণে আর কোনদিন স্কুল বন্ধ করেনি।’

জাহানারা বেগম বলেন, আমাদের অন্যান্য ভাই ও বোনেরা রাজীবের দুই ভাইদের কাপড়কিনে দিতেন। মাঝে মধ্যে আর্থিকভাবেও সহযোগিতা করতেন। এইচএসসি পাশ করেছিলেন খালার বাসা থেকেই তিুতমীরে ভর্তি হয়ে সে মেসে উঠে ছিলেন। তার আগে প্রায় ৬ বছর এই খালার বাসাই ছিলেন।

সে খালাতো ভাই আসিফের সঙ্গে ঘুমাতেন। আর ছোট বোন অহনাকে খুব ভালোবাসতেন। অহনার বয়স সবে মাত্র তিন বছর চলছে। সেও রাজীব ভাইকে ভুলতে পারছে না। রাজীব বাসার আসার আগে অহনার পছন্দের সব চকলেট নিয়ে আসতেন। সেই জন্য খালার কাছ থেকেও অনেক বকা খেতেন।
রাজীবের কোনো বোন ছিলো না। তাই তাকে খুব আদর করতেন। অহনা এখনো জানে তার রাজীব ভাই বাড়িতে আছেন। অহনা জানেনা তার ভাই মারা গেছে। সে জানে তার জন্য চকলেট নিয়ে আসবে রাজিব।

বিডি২৪লাইভ/এসআই/এসএস

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: