পহেলা মে'র আবেদন পুঁজিবাদের পকেটে

প্রকাশিত: ০১ মে ২০১৮, ১২:৩৪ এএম

আজ মহান মে দিবস। আজ থেকে ১৩২ বছর পূর্বে ধর্মঘটের অজুহাতে পুঁজিবাদী মানসিকতার ধ্বজাধারী মালিকদের দালাল ও সরকারের পেটোয়া বাহিনী যৌথভাবে শ্রমিকদের ওপর নিপীড়ন চালাত। গুলি চালিয়ে, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করত, চরম সভ্যতা আর বিশ্বায়নের এ যুগেও এমন ঘটনা যে ঘটছে না তা বলা সমীচীন হবে না। এখন তো ভয়ভীতি প্রদর্শন, মামলা-মোকদ্দমা দায়ের, গুম, অপহরণ ও হত্যা আরো কত কী করে শ্রমিকদের হেনস্তা, শায়েস্তা করা হয়, তার ইয়ত্তা নেই। পহেলা মের মর্মবাণী আজ মহাশূন্যে মিলিয়ে গেছে। আর পহেলা মে'র আবেদন মহাকালের স্রোতে ভেসে গেছে। তা না হলে রানা প্লাজায় হত্যাযজ্ঞের শ্রমিকরা প্রাপ্য সাহায্য, সেবা ও অর্থ পাচ্ছে না এমনটা ভাবা কেমন জানি অলীক স্বপ্নের মতো মনে হয়। 

পহেলা মে শ্রমিকশ্রেণির ছোটবড় অসংখ্য লড়াই-সংগ্রামের ফসল, রক্তপতাকার জন্মদিন। শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের ঐক্যের দিন। শ্রমঘণ্টা হ্রাস ও নির্ধারণের দিন। রক্তে ধোয়া মে'র পহেলা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিক দিবস। অধিকারবঞ্চিত, শোষিত-নিপীড়িত মজদুর শ্রেণির হিসাব মূল্যায়নের দিন। রক্তনিশান হাতে মেহনতি মানুষ দুনিয়ার সব প্রান্তে একত্রিত এদিনে অধিকার আদায়ের শপথে। দৃপ্ত উচ্চারণে মজদুর লাখো-কোটি কণ্ঠে উচ্চারণ করেন সেই বিভেদবিনাশী স্লোগান 'শ্রমিক ঐক্য জিন্দাবাদ'। 'দুনিয়ার মজদুর এক হও।' 'রক্তে ধোয়া মে তোমায় লাল সালাম'। 

এদিনে ওঠে একই আওয়াজ। দুনিয়া জুড়ে সব শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ হয়ে নবসংগ্রামের দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করেন। এদিন তো শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের 'সংগ্রামী দিনের হালখাতা'র দিন। কিন্তু আজ ১৩০ বছর পরে পহেলা মে'র আবেদন প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে।তাই ১৩১তম মে দিবস আজ আমাদের সামনে নতুন প্রত্যয়  ও সংগ্রামের আহ্বান নিয়ে নতুন উদ্যমে উপস্থিত।এক সাগর রক্তের বিনিময়ে কেনা প্রিয়তম জন্মভূমি বাংলাদেশে পহেলা মের আবেদন যেনো এক অনন্ত প্রত্যয়। পহেলা মের জন্ম হয়েছিল ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে ধর্মঘটী কারখানা শ্রমিকদের যে লড়াই রক্ত ঝরাচ্ছিল ঘন ঘন ওই সরকারি সেনা-পুলিশ, মালিকচক্রের পেটোয়া গুণ্ডাবাহিনীর নিষ্ঠুরতম আক্রমণের ফলে ফুঁসে ওঠা শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে। 

এমনি সময় ব্রিটেন, আমেরিকা ও ইউরোপের রুটির কারখানা, বিস্কুটের ফ্যাক্টরি, জুতা তৈরির কারখানা এমনি অগণিত কারখানার শ্রমিকরা তাদের ইউনিয়নের আহ্বানে রাজপথ দখল করে নিজেদের দাবি আদায়ের বার্তা পৌঁছাতে চেষ্টা করতেন মালিক চক্রের কাছে। কিন্তু যখন মালিকরা বহু কারখানা খুলতে পারত না, তখন শ্রমিকসাধারণের সঙ্গে কথা না বলে সরকারি সন্ত্রাসী বাহিনীর শরণাপন্ন হতো এবং দুয়ে মিলে আক্রমণ চালাত মজদুর সমাবেশের ওপর। নিহত-আহত হতেন শ্রমিক। গ্রেপ্তার করা হতো আর চলত অকথ্য নিপীড়ন-নির্যাতন। এমনই শান্তিপূর্ণ অধিকার-সংগ্রামকে সরকার-মালিক আঁতাতে তখনো দমন-পীড়নে শক্তি খাটাত। তাই তো এই 'মে দিন' সৃষ্টি হয়েছিল বীর শ্রমিকদের রক্তে এবং সাহসী সুদক্ষ সংগঠক আপসহীন নেতৃত্বের অবিরাম লড়াই-সংগ্রামে। 

শ্রমিকদের এ বীরত্বপূর্ণ লড়াই বন্ধ করতে গিয়ে সরকার আর কারখানা মালিকদের দালাল ও পেটোয়া বাহিনীর প্রকাশ্য এবং চোরাগোপ্তা আঘাতের উদ্দেশ্য ছিল শ্রমজীবীদের নিপীড়নে নিশ্চিহ্ন করা। কিন্তু তখনকার সময়েও শ্রমিকশ্রেণির প্রবল ঐক্যের সাহসী প্রত্যাঘাত মালিকদের চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়েছিল। কারণ ইউরোপ-আমেরিকার শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর একটা ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই। তাই সংঘবদ্ধতার শক্তিতে অনুপ্রাণিত শ্রমিকশ্রেণি সেদিন কিন্তু লড়াইয়ের ময়দানে কোনো দমন-পীড়নে হতোদ্যম বা হতাশ হননি। তারা নিরন্তর যে ধর্মঘট, সভা-সমিতি, সংগ্রামের লক্ষ্য স্থির করেছিলেন তাকে চাঙ্গা রাখার জন্য ইউনিয়ন নিয়মিত শুধু সংগ্রামের কর্মসূচি গ্রহণ করত তাই নয়, ধর্মঘট চলতে থাকলে ইউনিয়নই ধর্মঘটী শ্রমিকদের নিত্যদিনের খাবারের ব্যবস্থা করত। কারণ মালিক পক্ষ বেতন কাটত।  

এই যে কর্তব্যবোধ ইউনিয়নের, এ নীতির ফলে শ্রমিকশ্রেণির জঙ্গি সদস্যরাও সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে দ্বিধা করতেন না। এ ব্যবস্থা সেদিনের ধর্মঘটী মজদুরদের মনের সাহস অনেক বাড়িয়ে দিত এবং সংঘবদ্ধ থাকতে মনোবল জোগাত। তাই সহজে সরকার ও মালিক শ্রমিক ঐক্যের কাছে সংগ্রামের কর্মসূচি বাস্তবায়নে কখনো পিছপা হতে হয়নি। আমাদের দেশে একসময় এ ব্যবস্থা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছিল, কিন্তু এখন এর কোনো হদিস মেলে না। তা ছাড়া ইউনিয়ন তো আগের মতন দায়িত্বশীল ও সক্রিয়ও নয়। ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দলের হওয়ায় এটা এখন দলীয় সংগঠনে পরিণত হয়েছে। ফলে ইউনিয়নগুলো হয় নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে, না হলে দলের বশ্যতা স্বীকার করে নীরবতা পালন করছে।  

কোনো শ্রমিক  ইউনিয়নই সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। আগের দিনে ট্রেড ইউনিয়নগুলো ছিল বামপন্থীদের। তাই সাংগঠনিক দক্ষতা ও সংগ্রামের সাহস ছিল তাদের। আজকাল বামেদের মধ্যেও ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়বৃত্তির পরিমাণ ও পরিণাম 'কুৎসিত' আকার ধারণ করেছে। যারা লেজুড়ে পরিণত হয়নি, তাদের নামে সংগঠন আছে কিন্তু কাজে নেই।শুধু ১৮৮৬ সালেই নয়, আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে তারও আগে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৮৬ সালের মে মাসের বিভিন্ন সময় ও দিনক্ষণে এ ইউনিয়নগুলো ধর্মঘট করেছে কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে যখন ধর্মঘটী শ্রমিকদের এ লড়াই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে তখনই এ রক্তদান, প্রাণ বিসর্জন, জীবন উৎসর্গ করার ঘটনাবহুল মে মাসের কয়েকটি দিনকে সমন্বিত করে পরে ইউনিয়নগুলোর যৌথ বৈঠকে '১ মে'-কেই আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। সেই থেকে আমেরিকা ছাড়া বিশ্বের সব দেশেই পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। 

এ আন্দোলনের দাবি ছিল কাজের ঘণ্টা বেঁধে দিতে হবে সুনির্দিষ্ট করে। কারণ ওই সময় বিভিন্ন কারখানায় কাজের কোনো সীমা নির্ধারিত ছিল না। সে দাবিই ছিল প্রধান। ইউনিয়ন দাবি উত্থাপন করেছিল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম, ৮ ঘণ্টা বিনোদন। এ রক্তদানের মাধ্যমেই এ দাবি অর্জিত হয়েছিল, তাই তো শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা মাইকেল স্টিংকস, অ্যানজেলো প্রমুখের জীবনদানে এ দাবি অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল। পহেলা মে'র এই বিশাল অর্জন। আজও সে নিয়ম বহাল রয়েছে।আজ পৃথিবী পাল্টে গেছে, প্রযুক্তি উন্নয়নের দ্রুত রকমফেরে দুনিয়াটা যান্ত্রিক জগতে প্রবেশ করেছে। সেই সঙ্গে এই বাংলারও শ্রমিক আন্দোলন সংঘবদ্ধ ও প্রবল হয়ে উঠেছিল। 

ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী নৌ-বিদ্রোহ প্রবল আলোড়ন তুলেছিল। আর সে থেকে ডকশ্রমিক, রেলমজুর, কুলি-মজদুর, কারখানা শ্রমিক ৮ ঘণ্টা কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। তবে এর ব্যতিক্রমও ঘটছে বিগত কিছু বছর ধরে। ৮ ঘণ্টায় শ্রমিকদের অবিরাম কাজ করানো হচ্ছে। আবার পারিশ্রমিক, সময়ও ঠিকমতো দেয়া হচ্ছে না। কেউ কেউ বাধ্য করে 'ওভারটাইম' করাতে। কিন্তু ওভারটাইম তো শ্রমিকের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। যদি তিনি করতে না চান তবে মালিক বা তার প্রতিনিধি তাকে জোরপূর্বক ওভারটাইম করাতে পারেন না। এখানে ক্ষমতার দাপট, দালালির দৌরাত্ম্য, মোসাহেবির বাড়বাড়ন্ত শিল্পশ্রমিকদের সঠিক কাজ ও নির্ধারিত বেতন ঠিকমতো দিচ্ছে না। শ্রমিকসাধারণকে এর জন্য বহুভাবে হেনস্তা হতে হয় এবং হচ্ছে। 

পহেলা মে'র মর্মবাণী, শ্রমের মর্যাদা নিয়ে কথা বলা হলে আমাদের কাঁধেই দায় বর্তাবে। কারণ আমরা আইএলও নির্দেশিত রীতি-পদ্ধতি মেনে চলছি না। ন্যূনতম বেতন নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে লড়াই চলছে কিন্তু সৎভাবে এর কোনো বাস্তবায়ন হচ্ছে। না আজও মালিক পক্ষ 'বাড়তি' ব্যয় বৃদ্ধি করতে চায় না। যে শ্রমিকশ্রেণিকে লাঞ্ছিত, অপমানিত এবং বঞ্চিত করে মালিক পক্ষ মুনাফা লুটছে, তারা সেই শ্রমিকদের শোষণপ্রক্রিয়া ছাড়তে চাচ্ছে না। মুনাফার সমুদ্রে হাবুডুবু খেয়েও লাভের লোভ ছাড়তে চায় না মালিক পক্ষ। কয়েক বছর ধরে পোশাকশিল্প আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে দারুণ সহায়ক হচ্ছে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হলো, তাজরীন ফ্যাশনে আগুন লেগে শতাধিক লোকের অপমৃত্যু এবং রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৫ জনের অকালে প্রাণঘাত বিশ্বের ইতিহাসে বোধ হয় একমাত্র দুর্ঘটনা। 

যাতে এত মানুষের অপঘাতে নয়, জেনেশুনে পরিকল্পিতভাবে প্রাণ বিসর্জন দিতে হলো। এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে, তাতে আহত, পঙ্গু, বিকলাঙ্গ, মানসিক বৈকল্য ঘাতে কত যে জীবন তছনছ হয়ে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই। তাই শ্রমিকদের অধিকার প্রশ্নে কোনো আপসহীন ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া আজ সময়ের দাবী। নতুবা সভ্যতা বিনির্মাণের এই মহান কারিগরদের ম্লান মুখ ক্রমশ অন্ধকার বয়ে আনবে।

খোলা কলামে প্রকাশিত সব লেখা একান্তই লেখকের নিজস্ব মতামত। এর সাথে পত্রিকার কোন সম্পর্ক নেই।

বিডি২৪লাইভ/এমআর

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: