বিএনপিকে ফের ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছেন শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ১৩ মে ২০১৮, ০৮:০৪ পিএম

অমিত সেনগুপ্ত: ঢাকা শহরজুড়ে যত পোস্টার আছে, সেখানে দু’জনের চেহারাই দেখা যায় বেশি। একটি হলো ১৯৭১ সালে গণহত্যার মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের। অপরটি তার কন্যা, শাসক দল আওয়ামী লীগের প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের। বিরোধী দলীয় নেতাদের পোস্টার এখানে বেশ বিরল। আরও বিরল হলো বিরোধী নেতাদের দেওয়াল চিত্র বা গ্রাফিতি। এমনকি ডান-ঘরানার বিএনপি’র ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত খুলনা বিভাগেও, দলটির বা দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার কোনো পোস্টার বা ব্যানার দেখতে পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচন বয়কট করার ৩৫০ আসন বিশিষ্ট জাতীয় সংসদে দলটির কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই।

দুই বারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ২০১৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি ৫ বছরের জন্য কারাদ- দেওয়া হয়। তার স্বামী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নামে প্রতিষ্ঠিত একটি দাতব্য সংস্থা থেকে আড়াই লাখ ডলার তছরুফ করার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। কোনো ব্যক্তি দুই বছরের বেশি সাজা পেলে তার নির্বাচনে লড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। এ কারণে তার এই কারাদ- তাকে আগামী নির্বাচনে লড়ার ক্ষেত্রে কার্যত অযোগ্য করে দিয়েছে। ৭২ বছর বয়সী খালেদা কারাগারে এখন বেশ অসুস্থ বলে খবরে এসেছে। বাংলাদেশে এই বছরের অক্টোবর ও ডিসেম্বরের মাঝামাঝি যেকোনো সময় নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বস্তুত হিসাবের বাইরে। 

এটি এক অসম নির্বাচনী লড়াই। ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচন, যেটি খুবই বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেই নির্বাচনে অর্ধেকেরও বেশি আসনে একজনের বেশি প্রার্থীই ছিল না। লড়াই হয়নি যেসব আসনে, সেখানে আওয়ামী লীগ জিতেছে ৮৭টি। প্রতিদ্বন্দ্বীতা হয়েছে এমন ১৪৭টি আসনের ১০৫টি গেছে দলটির ঘরে। 

সেই জাতীয় নির্বাচনের এক সপ্তাহও যখন বাকি নেই, তখনও খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী করে রাখেন হাসিনা। এটিই মূলত খালেদা জিয়াকে আন্দোলন চালানো থেকে বিরত রাখে।

বিরোধী দলের মধ্যে একমাত্র একটি দলই এখনও সরকারের রোষের শিকার হয়নি, সেটি হলো আনুষ্ঠানিক বিরোধী দল, তথা ডানপন্থী রক্ষনশীল জাতীয় পার্টি (এরশাদ), যেটি গত ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৩৪টি আসনে জয়লাভ করে। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হলেন হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ, যিনি তিন দশক আগে এক ‘রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে’র মাধ্যমে নিজেকে দেশের দশম প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। 

নানাভাবে বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে মিত্রতা করেছেন এরশাদ। তবে ১৯৯০ সালের শেষের দিকে তার ৯ বছর ব্যাপী শাসনামলের অবসান ঘটায় হাসিনা-খালেদার সমন্বিত বিরোধী দল। তখন এরশাদকে উৎখাতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমন্বিত প্রচেষ্টার সমর্থক ছিল বামপন্থীরাও। এদের মধ্যে ছিল কম্যুনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। 
কিন্তু তখন থেকে ছোট আকারের (তবে আশ্চর্য্যজনকভাবে তেজী) বামপন্থী দলগুলো আড়ালে চলে গেছে। তাদের মধ্যে অল্প ক’টির এই পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব আছে। এর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির রয়েছে ৭টি আসন। জাসদের ৬টি। অথচ, ১৯৬৮-৬৯ সময়ে কৃষক-জনতার পক্ষে আন্দোলনের ডাক আসতো এই বাম দলগুলোর নেতৃত্বে বড় সভা থেকে। 

তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বামেরা এখনও শক্তিশালী। আগামী নির্বাচনেও এর ফল আসতে পারে। এই এপ্রিলে চাকরির কোটা অপসারণের দাবিতে বিরাট ছাত্র আন্দোলনে এই শক্তিরই প্রতিফলন ছিল। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের যত ভাস্কর্য আছে, সেগুলোর বেশিরভাগেই সোভিয়েত সমাজতন্ত্রী শিল্পের ছাপ আছে।

লোকবল ও অর্থ সংকট থাকলেও, বাংলাদেশের বামপন্থীরা হয়তো নিজেদেরকে ও দেশের গণতন্ত্রকে পুনর্জ্জীবিত করতে পারে বড় দুই দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিচক্ষণ জোটগঠনের মাধ্যমে। যদিও কম্যুনিস্ট পার্টি বিএনপির প্রতি নমনীয়, কিন্তু দলটি ১৮ দলীয় জোটে যোগ দেবে না জামায়াতে ইসলামির উপস্থিতি থাকায়।

খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলায় বামপন্থী বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আরিফুল ইসলাম সজীব বলেন, ‘বিএনপিকে প্রকাশ্যেই মৌলবাদীরা সমর্থন দেয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ইসলামপন্থীদের পরোক্ষ সম্পর্ক রয়েছে।’

আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির হলেও, আওয়ামী লীগ নিরবিচ্ছিন্নভাবে সেকুলার ছিল না। ১৯৭২ সালের সংবিধানে সন্নিবেশিত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি দলটি পুনরুদ্ধার করলেও, সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ রেখে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, হাসিনা এমন এক অবস্থান নিয়েছেন যে, শরিয়া আইন পছন্দ না করলেও, যারা ‘ইসলাম অবমাননা’র চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এটি ছিল ইসলামিস্ট দলগুলোর দাবি। এর ফলে দেশ দ্বি-খন্ডিত হয়ে গেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘দুই পক্ষের মধ্যে পার্থক্য এখন অস্পষ্ট। সেকুলার বুননকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে আওয়ামী লীগ সরকার অনেক কিছু করেছে।’ উদাহরণ হিসেবে হেফাজতের কাছে আওয়ামী লীগের আত্মসমর্পন, পাঠক্রমে পরিবর্তন, সংখ্যালঘুদের জমি দখলকারীদের সুরক্ষা, ইসলামিস্টদের খুশি রাখতে বিরাট অংকের অর্থ বরাদ্দকে তুলে ধরেছেন তিনি।

হাসিনা এখন বিএনপিকে ফের ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছেন। খালেদা জিয়া প্রচার চালাতে না পারলে, বিএনপি মাঠ পর্যায়ে অনেক সমর্থন হারাতে পারে। তবে বিএনপি যদি ফের নির্বাচন বয়কট করে, তাহলে দলটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন হারাবে। ২০১৭ সালের মে মাসে জাতীয় পার্টি ৫৮ দল বিশিষ্ট একটি জোট প্রতিষ্ঠা করেছে। এগুলো সবই ইসলামি দল। এদের মধ্যে মাত্র দুইটি দল নিবন্ধিত ও নির্বাচনে লড়তে পারবে।

এসব ২০১৪ সালের মতো ফের আওয়ামী লীগের জন্য বিপুল প্রতিদ্বন্দ্বীতাহীন জয়ের দ্বার খুলে দিতে পারে। প্রতিবেশী ভারতের মতো এসব কার্যত এক-দলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে। ইসলামিস্ট দলগুলোতে শেখ হাসিনার সমর্থন একেবারে অনুল্লেখযোগ্য নয়। বিএনপি-জামাত জোটে ফাটল ধরাতে এই ইসলামী দলগুলোর ‘ইসলাম প্রথমে’ নীতির সঙ্গে হাসিনা অনেকদিন ধরেই পাশাপাশি হাঁটছেন। দেশের অবরুদ্ধ গণতন্ত্র পারবে না এমন সমস্যাও দেখা দিতে পারে।(অমিত সেনগুপ্ত ভারতীয় সাংবাদিক। দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত তার লেখাটির সংক্ষেপিত অনুবাদ)। সূত্র: মানবজমিন।

বিডি২৪লাইভ/এমআর

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: