দাদার ফাঁদে নাতনী, অতঃপর
সাহাদাত হোসেন পরশ: ‘কী করে মেয়ের এমন অপবাদ সইব। মেয়েটা যে সম্মান নিয়েও মরতে পারল না। কলঙ্ক মাথায় নিয়ে চলে গেল। ওর সম্মান ফিরিয়ে দিতে পারবে কেউ? বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল মেয়েটার। এমন কষ্টের মধ্যেই পতিতাবৃত্তিতে জড়িত থাকার অভিযোগে আমার কলিজার টুকরাকে আবার পুলিশের কাছে সোপর্দ করে গ্রামবাসী। তদন্ত ছাড়াই মামলা দিল পুলিশ। এতো অপমান সহ্য করতে না পেরেই আত্মহত্যা করেছে মেয়েটা। তবু কারোর ওপর কোনো ক্ষোভ নেই। মামলা না করেই লাশ এনেছি। মামলা করলে কে আমাদের নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করবে। যেখানে তিন বেলার খাবার জোটাতেই হিমশিম খেতে হয়, সেখানে এতো ঝামেলা কীভাবে সামলাবো।’
রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার পূর্ব নাখালপাড়ায় বোনের বাসায় এভাবেই আহাজারি করে বুকচেরা কষ্টের কথা বলছিলেন কোহিনূর বেগম। গত ১০ মার্চ রাতে এই বাসার ছাদ থেকেই লাফ দিয়েছিল তার মেয়ে সূচনা ইসলাম। প্রথমে তাকে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। পরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় সূচনা মারা যায়। তাদের গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর পুঠিয়ার কাঁঠালবাড়িয়ায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রামবাসীর অভিযোগের ভিত্তিতে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৯০ ধারায় মামলা দিয়ে সূচনা ও তার দুই বন্ধুকে আদালতে পাঠানো হয়। সাধারণত কোনো যৌনকর্মী গ্রেফতার হলে ‘টু নাইনটি’ ধারায় মামলা দেওয়া হয়। সেই ধারায় দায়ের করা মামলার আসামি হওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই মানতে পারেনি স্কুলছাত্রী সূচনা।
কোহিনূর বেগম গণমাধ্যমকে জানান, তার স্বামী পাঁচ বছর আগে আরেকজনকে বিয়ে করে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। এরপর থেকে দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি পুঠিয়ায় শ্বশুরের বাসায় বসবাস করে আসছিলেন। তবে সেখান থেকে তাদের তাড়াতে নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকেন তার শ্বশুর অলি আহমেদ ও তার ছেলে শাহিন শেখ। আশপাশের কিছু খারাপ লোকজনকে নিয়ে নানা সময় কোহিনূর ও তার মেয়েদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা করত। সর্বশেষ গত ৮ মার্চ একটি অনুষ্ঠান দেখে ফেরার সময় অনেক রাত হয়ে গেলে চার বন্ধু সূচনাকে পৌঁছে দিতে তাদের বাসায় যায়। তারা বাসায় ঢোকার কিছু সময় পর সূচনার দাদাসহ কিছু প্রতিবেশী তাদের ঘরের বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ এসে দুই বন্ধুসহ সূচনাকে ধরে গভীর রাতে থানায় নিয়ে যায়। ছাড়াতে গেলে একজন পুলিশ পাঁচ হাজার টাকা দাবি করে। সেই টাকা দিতে না পারায় পরদিন অসামাজিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে দুই বন্ধুসহ তাকে আদালতে পাঠায় পুঠিয়া থানা পুলিশ। অপর দুই বন্ধু সেখান থেকে সরে যেতে সক্ষম হয়। ওই দিন বিকেলে জামিন পাওয়ার পর মেয়েকে নিয়ে বাসায় যান কোহিনূর। তবে সূচনার দাদা-দাদি ও অন্যরা তাদের ঘরে ঢুকতে দিতে আপত্তি জানায়। এরপর বাধ্য হয়ে ঢাকায় নাখালপাড়ার বোনের বাসায় চলে আসেন তারা। ১০ মার্চ খালার এই ভাড়া বাসার ছাদ থেকেই লাফিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে সূচনা। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর অবসান হয় সূচনার জীবনের।
ছবিতে কোহিনূর বেগম
কোহিনূর আরো জানান, চলতি বছরই রাজু আহমেদ নামে এক ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সূচনা। তবে অল্প দিনে রাজুর পরিবারের চাপে সে বিয়ে ভেঙে যায়। ব্যাপারটি কোনোভাবে মেনে নিতে পারছিল না সে। এরই মধ্যে আবার পুলিশের হাতে আটক হওয়ার গ্লানি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় তাকে।
সূচনার মা গণমাধ্যমকে আরো জানান, যে গ্রাম থেকে মিথ্যা কলঙ্কের বোঝা নিয়ে ঢাকায় আসতে হয়েছে, সেখানে মেয়ের লাশ নিয়ে যেতে চাননি। তাই নাখালপাড়ায় তার লাশ দাফন করেছেন। সূচনার মৃত্যুর খবর শোনার পরও তার দাদা বা ওই পরিবারের কেউ একবার তাদের দেখতেও আসেনি। কোহিনূর বেগম জানান, অসুস্থতার জন্য এ বছর এসএসসি পরীক্ষা শেষ করতে পারেনি সূচনা।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে সূচনার দাদা অলি আহমেদ দাবি করেন, সূচনা মাদকাসক্ত ছিল। তাই তিনি চেয়েছিলেন, সে অন্তত ৬ মাস জেলে থাকুক।
কীভাবে নিশ্চিত হয়েছেন সূচনা মাদকাসক্ত ছিল- এমন প্রশ্নে অলি আহমেদ বলেন, প্রতিবেশীরাই এমন অভিযোগ করত। ঘটনার সময় আশপাশের লোকজন দুই বন্ধুসহ সূচনাকে ধরে পুলিশে দেয়।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে রাজশাহীর পুঠিয়া থানার ওসি সাইদুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, একটি উঠতি বয়সী মেয়ের ঘরে গভীর রাতে দুই ছেলে কেন থাকবে? গ্রামবাসী তাদের ধরিয়ে দিয়েছিল। মেয়েটির এর আগেও ৩-৪টি বিয়ে হয়। কীভাবে সূচনাকে ভালো মেয়ে বলা যায়- এমন প্রশ্নও তোলেন তিনি।
কাঁঠালবাড়িয়ার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোখলেছুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ঘটনার দিন সূচনা ও তার মায়ের জন্য ফাঁদ পেতেছিল তার দাদা-দাদি ও আশপাশের কিছু অসাধু লোক। ঘটনার রাতে বাইরে থেকে চার বন্ধুসহ তালাবদ্ধ করে মা-মেয়েকে ধরিয়ে দেওয়া হয়। যে অভিযোগে তাদের ধরানো হয়েছে- এটা পুরোপুরি সাজানো। একটি চক্র চেয়েছিল সূচনার বন্ধুদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করতে। সেটা সম্ভব না হওয়ায় তারাই পুলিশে খবর দেয়। মেয়েটি এই শোক সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে।
মোখলেছুর রহমান আরো জানান, সূচনার তালাক হওয়ার সময় তার শ্বশুর পক্ষের লোকজনের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা আদায় করা হয়েছিল। এর মধ্যে দেড় লাখ টাকা স্থানীয় একটি চক্র আত্মসাৎ করে। যদিও সূচনার মোহরানা ছিল এক লাখ টাকা। যারা সূচনাকে ফাঁসিয়েছে, তাদের মধ্যে সূচনার দাদা-দাদি ছাড়াও শামীম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি রয়েছে। এ ছাড়া সূচনার দাদাও টাকার ভাগ পেতে কাউন্সিলরের কাছে যান।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব সূচনার শ্বশুর পক্ষের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা আদায় করে দেড় লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। বাকি মাত্র ৫০ হাজার টাকা সূচনার পরিবারকে দেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হাবিবুর রহমানের মোবাইল ফোনে কল করলে অন্য একজন রিসিভ করেন। তিনি বলেন- ‘হাবিব সালিশ নিয়ে ব্যস্ত আছেন।’
সূচনার সাবেক শ্বশুর শহিদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, তার ছেলের সঙ্গে এক লাখ টাকার কাবিন থাকলেও ফাঁকা স্ট্যাম্পে সই নিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে শামীমসহ কয়েকজন তাদের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা আদায় করে নেয়।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি আবদুর রশিদ গণমাধ্যমকে বলেন, সূচনার আত্মহত্যার ঘটনায় তার পরিবারকে বারবার অনুরোধ করার পরও তারা কোনো অভিযোগ করতে রাজি হয়নি। তাই ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ হস্তান্তর করা হয়। সূত্র: সমকাল।
বিডি২৪লাইভ/টিএএফ
বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
মার্কেটিং ও সেলসঃ ০৯৬১১১২০৬১২
ইমেইলঃ [email protected]
পাঠকের মন্তব্য: