জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে জিল বাংলা চিনিকলের আওতায় ২০২২-২৩ মৌসুমে আখ চাষ হয় ৩ হাজার ৩৯৮ একর। তখন মণপ্রতি আখের দাম ছিল ১৮০ টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ মৌসুমে ৪০ টাকা বৃদ্ধি করে মণপ্রতি আখের দাম ২২০ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। এতে চাষিদের মধ্যে আখ চাষের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ২০২৩-২৪ মৌসুমে ৬ হাজার ৫০০ একর জমিতে আখ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য্য করেছে মিলটি।
মিল সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ আখ মাড়াই মৌসুমে চিনিকলটি বন্ধের গুজবে চাষিরা আখ চাষ থেকে সরে দাঁড়াতে থাকেন। বাস্তবেও সেই মৌসুমে দেশের ছয়টি চিনিকলে আখ মাড়াই স্থগিত করে সরকার। জিল বাংলা চিনিকল কর্তৃপক্ষের দাবি, এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাদের। এ চিনি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে আখ চাষ বৃদ্ধির জন্য মাঠ পর্যায়ে দিনরাত ঘাম ঝরাতে হয়েছে মিলটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের । এর ফলে ২০২১-২২ আখ মাড়াই মৌসুমে বৃদ্ধিপায় আখ চাষ। সে মৌসুমে ৫ হাজার ৫৩২ একর জমিতে আখ চাষ হওয়ায় মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ায় মিলটি।
আখ চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২২-২৩ আখ মাড়াই মৌসুমে ৩৫ হাজার ১৭১ টন আখ মাড়াই করে ২ হাজার ৩২২ টন চিনি উৎপাদন করে মিলটি। মিল কর্তৃপক্ষের দাবি, মিল এলাকায় দিন দিন আখ চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ২০২২-২৩ মৌসুমে ৩ হাজার ৩৯৮ একর জমিতে আখ চাষ হয়েছিল। আখ চাষে চাষিদের আগ্রহ বৃদ্ধি ও চিনির দামের সাথে আখের মূল্যের সামঞ্জস্যতা আনয়নে সরকার আখের মূল্য বৃদ্ধি করেছেন। গত মৌসুমে আখের মূল্য ছিল প্রতিমণ ১৮০টাকা। চলতি মৌসুমে মণপ্রতি ৪০ টাকা বৃদ্ধিতে প্রতিমণ আখের মূল্য হয়েছে ২২০টাকা। সে কারণে চলতি ২০২৩-২৪ মৌসুমে আখ চাষ বৃদ্ধি পেয়ে ৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আখ চাষে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য্য করেছে মিলটির কর্তৃপক্ষ।
পোল্যাকান্দি নামাপাড়া গ্রামের আখ চাষি ফিরোজ মিয়া জানান, আখ চাষ লাভজনক। আখ চাষে ব্যয় ও পরিশ্রম তুলনামূলক কম। আখ বছর মেয়াদের ফসল হলেও বছর শেষে প্রতি বিঘা জমিতে ৩০ হাজারের বেশি টাকা মুনাফা পাওয়া যায়। বর্তমানে মিলে আখ সরবরাহ করে আখের মূল্য পেতে কোনো প্রকার ভোগান্তি নেই। আখ সরবরাহের অনুমতিপত্র (পূর্জি) পেতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে না। অন্যদিকে সরকার আখের মূল্য বৃদ্ধি করায় আখ চাষিরা চলতি মৌসুমে আখ চাষে ঝুঁকেছেন।
খড়মা গায়েনপাড়ার আখ চাষি আসগর আলীর ভাষ্য, গত মৌসুমে সে ৪ বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছিলেন। ফলনও ভালো হয়েছিল। কিন্তু‘ আখের মূল্য তুলনামূলক কম থাকায় লাভের অংক হয়েছিল কম। সরকার চলতি মৌসুম থেকে আখের মূল্য মণপ্রতি ৪০ টাকা বৃদ্ধি করেছেন। পূর্বে প্রতিমণ আখের মূল্য ছিল ১৮০ টাকা। ৪০ টাকা বৃদ্ধিতে এখন মণপ্রতি আখের মূল্য দাঁড়িয়েছে ২২০ টাকা। আখের মূল্য বৃদ্ধিতে তিনি এ মৌসুমে ৬ বিঘা জমিতে আখ চাষের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আখ চাষ বৃদ্ধির লক্ষ্যে মিল কর্তৃপক্ষ গোটা আখ উৎপাদনকারী ছয়টি সাব-জোনের আওতায় ৫৯টি ইউনিটে ভাগ করে চাষিদের আখ চাষে উদ্বুদ্ধকরণ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি সাব-জোনে সাবজোন প্রধান, উপ-ব্যবস্থাপক (সম্প্রসারণ), সহকারি ব্যবস্থাপক (সম্প্রসারণ) ও উপ-সহকারী ইক্ষু উন্নয়ন কর্মকর্তাগণ চাষিদের সাথে নিয়মিত মতবিনিময় করে আসছেন। তাঁরা চাষিদের দাদন হিসেবে প্রয়োজন অনুযায়ী সার, বালাই নাশক, উন্নত জাতের আখের বীজ ও প্রযুক্তিও সরবরাহ করে আসছেন।
জিল বাংলা চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) মো. আনোয়ার হোসেন জানান, জিল বাংলা চিনিকল এলাকার মাটি ও আবহাওয়া আখ চাষের উপযোগী। চাষিরা আখ চাষে অভিজ্ঞ ও বাস্তব জ্ঞান সম্পন্ন। তারা আখ চাষে উচ্চ ফলনের প্রক্রিয়া জানেন। আখের মূল্য বৃদ্ধিতে কৃষকগণ আখ চাষে আগ্রহী হওয়ায় ২০২৩-২৪ আখ রোপন মৌসুমে ৬ হাজার ৫০০ একর জমিতে আখ রোপনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী মাঠে কাজ চলছে। চলতি মৌসুমে ঈশরদী-৩৩, ৩৪, বিএসআরআই ৪০,৪৩ থেকে ৪৮ জাতের আখের বীজ সরবরাহ করা হয়েছে। এ জাতের আখের ফলন বিঘাপ্রতি ৩০০ থেকে ৪০০ মণ পর্যন্ত হয়ে থাকে। সরকার মণপ্রতি আখের মূল্য ১৮০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ২২০ টাকা করেছেন। এতে এ অ লের চাষিরা আখ চাষে আগের মতো ঝুঁকছেন। আখ চাষ বৃদ্ধিতে মিলটি আশানুরূপ চিনি উৎপাদন করতে সক্ষম হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
চুনিয়াপাড়া গ্রামের আখ চাষি মকবুল হোসেন মলু বলেন, এক বিঘা জমিতে সর্বনিম্ন ৩০০ মণ আখ উৎপাদন হলে আগের মৌসুমগুলোতে প্রতিমণ আখ ১৮০ টাকা দরে মিলে সরবরাহ করে পেয়েছেন ৫৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে এক বছরে আখ চাষে ব্যয় বাবদ ২০ হাজার টাকা বাদ দিলে চাষিদের বিঘা প্রতি নীট লাভ ৩৪ হাজার টাকা। কিন্ত চলতি মৌসুমে আখের মূল্য মণপ্রতি ৪০ টাকা বৃদ্ধিতে নীট লাভের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪২ হাজার টাকা।
ফারাজীপাড়া গ্রামের আখ চাষি আনিছুর রহমান জানান, অন্যান্য ফসলের তুলনায় আখ চাষে শ্রম দিতে হয় কম । আখ এক বছর মেয়াদের ফসল হলেও বছর শেষে লাভের টাকা একবারে পাওয়া যায়। তাছাড়া আখের মূল্য বৃদ্ধিতে এ বছর আখ চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা। গত বছর পাঁচ বিঘা জমিতে তিনি আখের চাষ করেছিলেন। আখের মূল্য বৃদ্ধিতে এবার তিন বিঘা জমিতে আখ চাষ বৃদ্ধি করে মোট আট বিঘা জমিতে আখ চাষ করছেন।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন ও জিবাচিক ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রায়হানুল হক রায়হান জানান, আখ চাষ অন্যান্য ফসলের তুলনায় অত্যন্ত লাভজনক। আখের মূল্য বৃদ্ধিতে এ মৌসুমে আখ চাষ বৃদ্ধি পাবে। জিল বাংলা চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ চাষ বৃদ্ধিতে তোড়জোড় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আখ চাষি কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান মোল্লা জানান, আখের মূল্য বৃদ্ধিতে চাষিরা আনন্দিত। জিল বাংলা চিনিকল কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টায় এ চিনি শিল্প আখ চাষ বৃদ্ধিতে চিনি উৎপাদনের লক্ষমাত্রা অর্জন করে আবারও প্রাণ ফিরে পারে।
বিগত পাঁচ বছরের তথ্যানুসন্ধ্যানে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ মৌসুমে ১০১ দিনে ৫ হাজার ২২২টন, ২০১৯-২০ মৌসুমে ৮৫ দিনে ৫ হাজার ১৫৩ টন, ২০২০-২১ মৌসুমে ৭২ দিনে ৩ হাজার ৯০৮ টন, ২০২১-২২ মৌসুমে ৪৪ দিনে ২ হাজার ৪৯৮ টন, ২০২২- ২৩ মৌসুমে ৪১ দিনে ২ হাজার ৩২২-টন চিনি উৎপাদন হয়। আখের মূল্য বৃদ্ধিতে চলতি ২০২৩-২৪ আখ
মাড়াই মৌসুমে আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে। এ মৌসুমে ৫৫ হাজার টন আখ মাড়াই করে ৩ হাজার ৮৫০ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছে মিলটি।
অন্যদিকে ২০১৮-১৯ মৌসুমে ১০ হাজার ২০০ একর, ২০১৯-২০ মৌসুমে ৯ হাজার ১০০ একর, ২০২০-২১ মৌসুমে ৩ হাজার ৪১৬ একর, ২০২১-২২ মৌসুমে ৫ হাজার ৫৩২ একর, ২০২২-২৩ মৌসুমে ৩ হাজার ৩৯৮ একর জমিতে আখ চাষ হয়েছিল। আখের মূল্য বৃদ্ধিতে চলতি ২০২৩-২৪ রোপন মৌসুমে ৬ হাজার ৫০০ একর জমিতে আখ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে মিলটি।
কথা হয় জিল বাংলা চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বিক হাসানের সাথে। তার ভাষ্য, মিল বন্ধের গুজবে চাষিরা আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। আখের দাম বৃদ্ধিতে চাষিরা আবারও পূর্বের মতো আখ চাষে ঝুঁকেছেন। এতে চাষিরা অন্যান্য ফসল চাষের তুলনায় বেশি পরিমাণে লাভবান হবেন। কারণ এ মাটি ও আবহাওয়া আখ চাষের অনুকূলে। উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল জাতের আখ চাষ করে চাষিরা বেশি লাভবান হবেন। আখ চাষ বৃদ্ধি পেলে মিলটিতে বাড়বে চিনি উৎপাদন। সে কারণে আখ চাষ বৃদ্ধির জন্য মিল কর্তৃপক্ষ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।