চোরাকারবারিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হচ্ছে সুনামগঞ্জে সীমান্তবর্তী ৫টি উপজেলার এলাকা গুলো। রাত ১২টার পরই সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের চিত্র পাল্টে যায়। শিল্পনগরীর মতো চোরাইপণ্যবাহী গাড়ি দাপিয়ে বেড়ায় সড়কগুলোতে। বিষয়টি বর্তমানে ‘ওপেন সিক্রেট’ হলেও কেউ যেন এর দায় নিচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে দুয়েকবার অভিযান চালালেও অদৃশ্য কারণে বন্ধ হচ্ছে না এসব চোরাচালান ও তাদের নেপথ্যে থাকা রাঘব বোয়ালরা।
এদিকে সুনামগঞ্জের চোরাকারবার বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বিগ্ন সচেতন নাগরিক ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ। অবৈধ ব্যবসা দেশের অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে জানান তারা। সীমান্তে চোরাচালন বন্ধে সরকারের তৎপরতা কামনা করছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোনো ধরনের সরকারি বৈধতা ছাড়াই সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করে সুনামগঞ্জ সদর, তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার উপজেলার ৩টি সীমান্ত হাট ছাড়াও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকার অন্তত ২৭টি চোরাই পথ দিয়ে জেলায় আসছে ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করছে ভারতীয় চিনি, পেঁয়াজ, কসমেটিক্স, প্রসাধনী, পোশাক, ফলমূল ও গবাদিপশু।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, প্রতিদিন বিকেল হলেই পাল্টে যায় সীমান্তের চিত্র। ভারত থেকে পণ্য নিয়ে আসতে চোরাকারবারিদের আছে নিজস্ব শ্রমিক। বস্তা কিংবা কার্টন প্রতি মজুরিতে কাজ করেন শ্রমিকরা। সীমান্ত এলাকায় ভোররাত পর্যন্ত চলে অপকর্মযজ্ঞ। সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রভাবশালীসহ এই চোরা কারবারের সাথে জেলা উপজেলা পর্যায়ের অনেক ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা-কর্মী সম্পৃক্ত থাকার তথ্য পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সুনামগঞ্জ সদর, তাহিরপুর ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় ভারত বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ৩টি সীমান্ত হাট রয়েছে। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে এই বাজার থেকে স্বল্প পরিসরে স্থানীয় উৎপাদিত পণ্য কেনাবেচার বিধান থাকলেও কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে এসব হাটে কোটি কোটি টাকার বহুজাতিক পণ্য শুল্কছাড়া দেশে প্রবেশ করাচ্ছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। পরবর্তীতে সেই অবৈধ পণ্যগুলো ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
এদিকে ৩ সীমান্ত হাট ছাড়াও সংশ্লিষ্ট উপজেলার সীমান্ত এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে চোরাকারবারিদের সিন্ডিকেট। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতি রাতে দেদারসে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন ভারতীয় অবৈধ পণ্য।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, তাহিরপুর উপজেলার লাউড়েরগড়, চারাগাঁও, বারেকটিলা, চাঁনপুর, রজনি লাইন, বড়ছড়া, বাগলী, লামাকাটা, জঙ্গলবাড়ি, মধ্যনগর উপজেলার মহেশখলা ও কলমাকান্দা, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ডলুরা, মালাইগাঁও, চিনাউড়া, কান্দিগাঁও, আশাউড়া, নৈগাং, বাংলাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর, চিকারকান্দি, বাঘবেড়, চেংবিল, শরীফগঞ্জ, মথুরকান্দি এবং দোয়ারাবাজার উপজেলার বোগলা ও লক্ষ্মীপুর মধ্যবর্তী ভাঙ্গাপাড়া, নরসিংপুর ও বাঁশতলা সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতীয় পণ্য প্রবেশ হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, সীমান্তের নিরাপত্তায় নিয়োজিত কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে নিরাপদে চোরাই পণ্য দেশে প্রবেশ করানো হয়। তাদের সহযোগিতায় রয়েছে আরেকটি চক্র। তারা নিজেদের পুলিশ এবং সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। প্রতিদিন কয়েক হাজার বস্তা চিনি বা পেঁয়াজ বের হয় এর পাশাপাশি ভারতীয় বিভিন্ন ব্যান্ডের মাদক আসে এসব রুটে তার হিসাব অনুযায়ী হয় দর কষাকষি।
অনুসন্ধানে আরও জানাজায়, তাহিরপুর উপজেলার সীমান্ত পথে আসা অবৈধ কিছু পণ্য যায় সড়ক ও নদীপথে নেত্রকোণা-কমলাকান্দা হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে। বিশ্বম্ভরপুর ও সদর উপজেলার সীমান্তের ভারতীয় পণ্য শহরের সঙ্গে যোগাযোগের সংযোগস্থল আব্দুজ জহুর সেতু হয়ে ছোট বড় ট্রাক ও কার্গো দিয়ে শহর থেকে বের করা হয়। দোয়ারাবাজারের সীমান্তের পণ্য ছাতক হয়ে চলে যায় অন্যত্র।
গেল মঙ্গলবার দিনভর সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়,জেলার বিশ্বম্ভরপুর এলাকার চালবন, পলাশ, কারেন্টের বাজার, চিনাকান্দি এলাকায় সারিবদ্ধ করে রাখা হয় অসংখ্য পণ্যবাহী ট্রাক কার্গো। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান,এসব ট্রাকে করে রাতে পণ্য নিয়ে যান চোরাকারবারিরা।
১২টার পর জেলা শহরের প্রবেশ মুখে আব্দুজ জহুর সেতু এলাকায় অবস্থান করে দেখা যায়,লাইন ধরে দ্রুত গতিতে সুনামগঞ্জ-সিলেট রোডের দিকে ছুটছে ত্রিপলে মোড়ানো পেঁয়াজভর্তি ট্রাক। সেতু থেকে সামান্য দূরে রাধানগর পয়েন্টে একটি ট্রাকের দেখা মিলে। ট্রাকের সামনে কয়েকজন দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ট্রাকে কি আছে জানতে চাইলে কেউ উত্তর দিতে রাজি হননি। এক পর্যায়ে দ্রুত গতিতে স্থান ত্যাগ করে গাড়িটি।
সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, সুনামগঞ্জ ইদানীং চোরাকারবারিদের জোনে পরিণত হয়েছে। আগে এমনটা ছিলনা। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো এই ব্যবসার সাথে আমাদের তরুণ ছেলেরা যুক্ত হয়ে পড়ছে। এটি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। আমি এ নিয়ে মাসিক আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় কথা বলেছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সকল শ্রেণীর লোকদের সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।
সুনামগঞ্জ বিজিবি সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জ ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় জেলার ৯২ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা রয়েছে। এরমধ্যে ৮৮ কিলোমিটার কাঁটা তার রয়েছে। বিশাল সীমান্ত এলাকা যথাযথ পাহারা দিতে পর্যাপ্ত জনবলের ঘাটতি রয়েছে। রয়েছে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অভাব। সংঘবব্ধ চোরচক্র এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পণ্য দেশে প্রবেশ করে থাকে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সুনামগঞ্জ জেলা পুলিশের তথ্যমতে, ২০২২ সাল থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত পুলিশের বিশেষ অভিযানে সুনামগঞ্জে ১৯২ দশমিক ৯ টন চিনি জব্দ করা হয়। সেই সঙ্গে ১৯৭ জন চোরাকারবারিকে আটক করে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী মামলা করা হয়েছে।
নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও চোরাকারবার প্রতিরোধে ২৮ বিজিবির পরিচালক লে. কর্নেল মাহবুবুর রহমান বলেন, সীমান্তে চোরাচালান রোধে বিজিবি আগের চেয়ে অনেক তৎপর। প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করে ভারতীয় পণ্য জব্দ করা হচ্ছে। আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। চোরাচালান বন্ধে জনপ্রতিনিধির পাশাপাশি সচেতন শ্রেণির লোকদের সোচ্চার হওয়ার আহ্বান এই কর্মকর্তার।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ এহসান শাহ্ বলেন, সুনামগঞ্জে আমরা বড় বড় চালান জব্দ করেছি। এসব কাজে সীমান্তের গুটি কয়েক লোক জড়িত রয়েছে। চোরাচালান বন্ধে আমরা নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। বিশেষ করে আঞ্চলিক সড়কে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। চোরাচালানের সাথে কোনো পুলিশ সদস্য জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সর্বশেষ খবর