কক্সবাজারে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষিত হচ্ছে। সৈকত তীরের কলাতলী অংশে নির্মাণাধীন স্থাপণায় অভিযানে সরঞ্জাম সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ পেয়েও থামছে না নির্মাণ কাজ। উল্টো সংশ্লিষ্টদের অনুমোদন ব্যতিরেখে রাত-দিন বিরামহীন চলছে নির্মাণ। এতে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) ও জেলা প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিবশেবাদীরা।
সূত্র মতে, পরিবেশগত বিবেচনায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে টেকনাফ সমুদ্র সৈকতের ১০ হাজার ৪৬৫ হেক্টর এলাকার প্রাণ বৈচিত্র্য, নির্মল জলরাশি এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় সরকার ১৯৯৯ সালে এ এলাকাকে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। এ নির্দেশনা মতে, ১২০ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত, সৈকতের ঝাউ গাছসমৃদ্ধ ৩০০ মিটার উন্নয়ন নিষিদ্ধ ও ৫০০ মিটার সংরক্ষিত এলাকা। লাবণী পয়েন্টে ২০১৭ সালে সার্কিট হাউজ নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে ১০ তলা ভবন তৈরির সিদ্ধান্তে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ থেকে ছাড়পত্র দিয়েছে দেখে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা এক রীটের বিপরীতে ‘ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান ফর কক্সবাজার টাউন এন্ড সি আপ টু টেকনাফ’ মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী জোয়ার ভাটার মধ্যবর্তী লাইন থেকে পৌরসভার প্রথম ৩০০ মিটার ‘নো ডেভেলপমেন্ট জোন’ উল্লেখ করে এ এলাকায় কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না বলে নির্দেশনা দেয় উচ্চ আদালত।
এরপর ইসিএতে পূর্বে বরাদ্দ পেয়ে স্থাপনাহীন থাকা অর্ধশতাধিক প্লট কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের আবেদনের প্রেক্ষিতে বাতিল করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি কউকও সৈকত হতে ৩০০ মিটারে কোন স্থাপণা নির্মাণ থেকে বিরত থাকতে প্রচারণা চালায় এবং বাতিল বলে ঘোষণা হয় পূর্বে নেয়া স্থাপণা নির্মাণ অনুমতিও।
এরপর হতে কলাতলী ও লাবণী পয়েন্টে কোন নতুন স্থাপণা না উঠলেও চলতি বছরের শুরু হতে এসব এলাকার একাধিক প্লটে দেদারসে নির্মাণ কাজ চলছে। গত মাস দেড়েক ধরে কলাতলীর তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইস ও ডিভাইন ইকো-রিসোর্টের মাঝখানে এমদাদ হোসেনের বরাদ্দ খালি জমিতে দিন-রাত সমান তালে নির্মাণকাজ চালছিল। বেলাভূমির দেড়-দু'শ ফুট দুরত্বে চারপাশে দেয়াল তোলে ডজনাধিক শ্রমিক ব্যাজমেন্ট পাকা করণের পর প্রথম তলা তৈরী করতে পিলার ও ছাদের লোহা বাঁধার কাজ করছিল। এখানে বাঁধাহীন স্থাপনার কাজ হচ্ছে দেখে আশপাশের একাধিক প্লটে মাটি ভরাটের কাজ চলে। এতে ইসিএ রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মুখথুবড়ে পড়ছে খবর পেয়ে জেলা প্রশাসনের নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেট (পর্যটন সেল) মাসুদ রানা গত ৩ জুন অভিযান চালান।
কক্সবাজার সৈকত তীরের ইকোলুজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়ায় (ইসিএ) ভবন নির্মাণ বন্ধে অভিযান চালিয়েছে জেলা প্রশাসন। আদালতের নির্দেশনা উপক্ষো করে নিষিদ্ধ ইসি এলাকায় ভবন নির্মাণ বিষয়ে সোমবার (৩ জুন) কয়েকটি গণমাধ্যমে তথ্যবহুল সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিকেলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেট (পর্যটন সেল) মাসুদ রানার নেতৃত্বে একটি টিম এ অভিযান চালান।
অভিযানে কলাতলী জোনের এমদাদ হোসেনের নির্মানাধীন ভবনসহ একাধিক প্লটের চলমান কাজ বন্ধ করে স্থাপনাসমূহ আগামী তিনদিনের মধ্যে নিজস্ব উদ্যোগে সরিয়ে নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়।এরপর স্থাপনা সরানো না হলেও দু'দিন কাজ বন্ধ ছিল। কিন্তু অদৃশ্য কারণে, বৃহস্পতিবার সকাল হতে অনবরত নির্মাণ কাজ চলছে। অভিযানে সরানো ছাদ ঢালাইয়ের বাঁধাই সমানতালে গাঁথা হচ্ছে। শ্রমিকদের মতে, রবিবার অফিস খোলার আগে প্রথম তলার ঢালাই সম্পন্ন করতেই প্লটের মালিক অবস্থান করছেন।
কিন্তু তথ্য মতে, এমদাদ হোসেনের যে প্লটে কাজ চলছে সেখানে ভবন করা যে অনুমোদনের আবেদন তা ২০১৫ সালে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ও ২০১৬ সালে গণপূর্তের নির্বাহি প্রকৌশলীর স্বাক্ষরে অনুমোদন পাওয়া একটি প্লান। অথচ ইসিএ নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পর ২০১৭ সালের আগের সকল অনুমোদন শর্তসাপেক্ষে বাতিল বলে ঘোষণা দেয় ততকালীন কউক কর্তৃপক্ষ। তবে, কউকের বর্তমানে কর্মরত কোন না কোন অফিসারের গোপন পরামর্শে কাজ করা হচ্ছে বলে প্রচার রয়েছে।
যাত্রা থেকে তিন মেয়াদে দায়িত্বপালন করা কউকের সাবেক চেয়ারম্যান লে. কর্ণেল ফোরকান আহমেদ বলেন, কউক স্বতন্ত্র যাত্রার আগে পৌর এলাকায় কক্সবাজার পৌরসভা থেকে পাওয়া অনুমতিতে ভবন নির্মাণ হয়েছে। পৌর অনুমতি পেলেও ২০১৬ সালে কউক স্বতন্ত্র কার্যক্রম শুরুর আগপর্যন্ত যেসব প্লটে নির্মাণ কাজ নির্ধারিত পরিমাণ হয়নি, তদন্ত সাপেক্ষে সেসব প্লটের প্লান বাতিল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০১৭ সালের পর থেকে নতুন কোন স্থাপণা করতে গেলে কউক এবং সংশ্লিষ্ট আরো একাধিক প্রতিষ্ঠান হতে অনুমতি বাধ্যতামূলক। আর সরকার ও উচ্চ আদালত কর্তৃক ঘোষিত ইসিএতে কোন মতেই অনুমতি দেয়ার সুযোগ কউক বা অন্য প্রতিষ্ঠানের নেই।
কলাতলীতে কাজ চলা একটি প্লটের জমির মালিক এলিগেন্স ডেভেলপমেন্ট প্রপার্টিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান এমদাদ উল্লাহ বলেন, সংশ্লিষ্টদের অনুমতি সাপেক্ষে কাজ চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। আমার জায়গা আদালতের নিষেধাজ্ঞায় পড়েনি। কাজ এগিয়ে নিতে গণমাধ্যমকর্মীদের সহযোগিতা চান তিনি।
অপরদিকে, ৩ জুনে প্রশাসনের অভিযানের পর অন্য প্লটে মাটি ভরাট ও স্থাপণা নির্মাণ কাজ এখনো বন্ধ রয়েছে। ইতোপূর্বে সেখানে প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে স্থাপনা তৈরীর কাজ চলমান ছিল।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. ইয়ামিন হোসেন মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও কোন জাবাব দেন নি তিনি।
ভবন নির্মাণ কউকের পারমিশন ছাড়া অসম্ভব। আমরা কাউকে বেআইনী সহযোগিতা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। এ নামের (এমদাদ) কাউকে আমি চিনি না- ইসি এলাকায় ভবন নির্মাণ বিষয়ে কারো সাথে আমার বৈঠক বা কথাও হয়নি।
এ বিষয়ে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) সচিব মো. আবুল হাসেম গণমাধ্যমককে বলেন, বিষয়টি চেয়ারম্যান স্যারের নলেজে আছে। তিনি যেভাবে নির্দেশনা দিবেন সেভাবে এগুনো হবে।