
দেশের অন্যতম শীর্ষ ফল ঈশ্বরদীর লিচু।এখানকার মাটি উর্বর হওয়ায় ঈশ্বরদীর লিচুর দেশ জুরে বেশ বিখ্যাত।দেশের স্বনাম পেরিয়ে এখানকার লিচু আন্তর্জাতিক ভাবে বিদেশে ও রপ্তানি করা হয়।অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার হওয়ায় এখানকার মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন,লিচু চাষের জ্বলুষ হারাচ্ছেন এখনকার কৃষকরা।এই উপজেলায় প্রায় ৪২ বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে লিচুর চাষ হয়। লিচু মৌসুম এলেই এ উপজেলার ৭ ইউনিয়নের ১২৩টি গ্রাম লিচুর রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। লিচু এ উপজেলার কৃষকদের প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে দেশ জুরে স্বনাম কুড়িয়েছেন । প্রতিবছর এখানে প্রায় ২৫ -৩০ হাজার মেট্রিক টন লিচু উৎপাদন হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় ৬০০-৭০০কোটি টাকা।
উপজেলার সবচেয়ে বেশি লিচুর চাষ হয় মিরকামারী, চরমিরকামারী, মানিকনগর, জয়নগর, আওতাপাড়া, জগন্নাথপুর, কদিমপাড়া, মহাদেবপুর ও সাহাপুর ইউনিয়ন গ্রাম গুলাতে। লিচু মৌসুম শুরু হলেই এখানকার চাষিদের কর্মতৎপরতা বেড়ে যায়। পাশাপাশি সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ীদের প্রায় তিন মাস জুড়ে শুরু হয় বেচাকেনা।চাষি ও সার-কীটনাশক ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, এ উপজেলায় লিচুর মৌসুমে ৭৫-৮০ কোটি টাকার সার-কীটনাশক ব্যবহার হয়। প্রতিবছর ব্যাপকহারে সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এখানকার মাটি উর্বরতা হারাচ্ছে। তারপরও প্রতিবছর বাড়ছে সার ও কীটনাশক ব্যবহার। যা পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি ও মানবদেহের ক্ষতি করছে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এ উপজেলায় ৩ হাজার ১শ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়। যেখানে ছোট বড় ৩ লাখ ৬০ হাজার লিচুগাছ আছে। প্রতি বছর এখানে ৫০০-৬০০ কোটি টাকার লিচু উৎপাদন হয়।কৃষকরা জানান, মুকুল আসার পর থেকে লিচু সংগ্রহ পর্যন্ত প্রতিটি গাছে ১৫-২০ প্রকারের সার, কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হয়। লিচু গাছের বয়স ও আকার অনুযায়ী সার-কীটনাশকের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। ৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী গাছে ২২০০ থেকে ২৫০০ টাকা, ১৫ বছরের গাছে ১৮০০-২০০০ টাকা ও ১০ বছরের নিচে গাছে ১৫০০-১৮০০ টাকার সার-কীটনাশক ব্যবহার করা হয়।
তারা জানান, সার ও কীটনাশকের সঠিক হিসাব করা যায় না। আবহাওয়া পরিস্থিতির ওপর সার-কীটনাশকের ব্যবহার নির্ভর করে। আবহাওয়া খারাপ থাকলে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশকের ব্যবহার বেড়ে যায়। ফলে খরচও বাড়ে। তবে মাঝারি সাইজের (১৫ বছর বয়সী) একটি লিচু গাছে দুই হাজার টাকার সার ও কীটনাশক ব্যবহার হয়। ফলে উপজেলার ৩ লাখ ৬০ হাজার লিচু গাছে প্রতিবছর ৭২-৮০ কোটি টাকার সার ও কীটনাশক ব্যবহার হয়।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লিচু চাষে ১৫ থেকে ২০ ধরনের সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা, মুকুল ঝরা রোধ, গাছ সুস্থ ও ফল বৃদ্ধি, লিচুর কালার ঠিক রাখা, ছত্রাক থেকে রক্ষাসহ নানান কারণে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। লিচুর মুকুল বের হওয়ার পর বেশি ব্যবহার করা হয় সাইপার মেথ্রিন, নাইট্রোভেনজিন গ্রুপের কীটনাশক স্প্রে। এরপর গাছের বয়স অনুযায়ী জৈবসার ও গোবর, এমপিও, টিএসপি, কার্বোফুরান, বরিক এসিড, সালফার ৮০ ডব্লিউ, জিংক সালফেট (দস্তা), ডেপ মিক্সার সার, ইমিডাক্লোপ্রিড ও ফিপ্রোনিল, ল্যাম্বডা, কার্বোন্ডাজিম, ভিটামিন (পিজিআর) পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও হঠাৎ পোকা ও ছত্রাকের আক্রমণ বেড়ে গেলে কৃষি কর্মকর্তা ও কীটনাশক ব্যবসায়ীদের পরামর্শে প্রয়োজনে আরও নানান ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা হয়।
মৃত্তিকা সম্পদ গবেষক ও পরিবেশবিদরা বলেন, ফসলি জমি থেকে মাটির আবশ্যিক জৈব পদার্থের অনুপস্থিতি ক্রমশই মাটিকে নিথর করে দেয়। এর অন্যতম কারণ হলো অত্যাধিক রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার। ঈশ্বরদীর লিচু ও সবজির জমির মাটিতে হেভিমেটালের (ভারী ধাতু) পরিমাণ স্বাভাবিকের তিনগুণ বেশি। ফলে এসব জমিতে হেভিমেটাল দূষণের প্রভাবে এখানে উৎপাদিত ফসল খাদ্যচক্রে ঢুকে মানুষের বিপদ ডেকে আনছে। মানুষের শরীরে নানান ধরনের রোগবালাই বাড়াচ্ছে। এখানকার মাটি পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য কোনো কিছুর জন্যই নিরাপদ নয়।উপজেলার সলিমপুর ইউনিয়নের শাহিন বলেন, আমার ১৫ বিঘার লিচুর বাগান আছে।প্রায় ৪০০ লিচুর গাছ আছে। নিজেই বাগানের পরিচর্যা করি। নিজে হিসাব করে দেখেছি ১৫ বছর বয়সী একটি লিচু গাছে প্রায় দুই হাজার টাকার সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। ফলে লিচু মৌসুমে এ উপজেলায় কোটি কোটি টাকার সার ও কীটনাশক ব্যবহার হয়। কীটনাশক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলেও লিচু চাষে কীটনাশক ব্যবহার করতেই হবে।
স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত লিচুচাষি আব্দুল জলিল ওরফে কিতাব মন্ডল বিডি২৪ লাইভ কে বলেন, এ অঞ্চলের কৃষকরা যথাযথ অভিজ্ঞতার অভাবে লিচু চাষে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছে। এতে এ অঞ্চলের মাটির স্বাস্থ্য চরম বিঘ্নিত হচ্ছে। এ উপজেলায় ৩৩-৩৫শ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয় তাতে প্রায় প্রতি মৌসুমে ৭৫ থেকে ১০০ কোটি টাকার সার-কীটনাশক ব্যবহার হয়। যথাযথ প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে ইচ্ছামতো কৃষকরা সার-কীটনাশক ব্যবহার করছে। এটি যে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সেটা চাষিরা কিছুটা উপলদ্ধি করতে না পারলেও কিছু কৃষক তা অনুধাবন করতে পারছে। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার খুঁজে পাচ্ছে না। কৃষকরা যদি প্রচুর পরিমাণে জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক উৎপাদন ও ব্যবহার করতে পারতো তাহলে এ সংকট থেকে ধীরে ধীরে পরিবেশ স্বাভাবিক হতো।
উপজেলার সলিমপুরের মানিকনগর গ্রামের সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী মোস্তাফা নয়ন বিশ্বাস বলেন, লিচু মৌসুমে প্রচুর সার ও কীটনাশক বিক্রি হয়। এ অঞ্চলে শতাধিক সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী রয়েছেন। আমার নিজের দোকানে এ মৌসুমে ২৫-৩০ লাখ টাকার সার ও কীটনাশক বিক্রি হয়। আমাদের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও বিভিন্ন কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি রয়েছেন, তারা সার-বীজ ব্যবহারের বিষয়ে কৃষকদের নানান ধরনের পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন।উপজেলার পাঠশালা মোড়ের কীটনাশক ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এ এলাকার শত শত লিচু বাগানে প্রচুর পরিমাণে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এ সময় আমাদের বেচাকেনা ভালো হয়। কীটনাশক ও সার বিক্রির পাশাপাশি লিচু চাষিদের এর ব্যবহারের বিষয়েও পরামর্শ দিয়ে থাকি।ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার বলেন, এ উপজেলায় ৩১০০ হেক্টর জমিতে লিচু উৎপাদন হয়। প্রতি মৌসুমে ৫০০-৬০০কোটি টাকার লিচু বিক্রি হয়। ব্যাপক পরিমাণ লিচু উৎপাদনের কাঙ্ক্ষিত ফলন পেতে গেলে সঠিক পরিমাণে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। এ বিষয়ে কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। এর পাশাপাশি নিরাপদভাবে লিচু উৎপাদনের জন্য লিচুর ব্যাগিংসহ জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে উৎসাহিত করছি। চেষ্টা করছি যেন মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করে জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করে।মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউট পাবনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ফারুক হোসেন বলেন, ঈশ্বরদীর কৃষি জমি সার্ভে এবং মাটি সংগ্রহ করেছি। কৃষি জমির মাটির স্বাস্থ্যের অবস্থা খুবই খারাপ। মাটিতে প্রচুর পরিমাণে সোডিয়াম রয়েছে।
অসমমাত্রায় সার ও কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে মাটির স্বাস্থ্য চরমভাবে বিঘ্নিত হয়েছে।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. মো. রেদওয়ানুর রহমান জানান, ঈশ্বরদীর লিচুর আবাদের জমির মাটি ও পানির নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা করে দেখেছি মাটিতে হেভিমেটালের (ভারী ধাতু) পরিমাণ খুব বেশি। স্বাভাবিক মাটির চেয়ে এখানকার মাটিতে তিনগুণ বেশি ভারী ধাতু রয়েছে। যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ জমিতে উৎপাদিত ফসল মাটি ও পানির মাধ্যমে খাদ্যচক্রে ঢুকে মানুষ নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কিডনি, লিভার, গর্ভপাত ও ডায়বেটিসের মতো জটিল রোগের পাশাপাশি ভবিষ্যত প্রজন্ম মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
সর্বশেষ খবর