কক্সবাজারের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারিদের একজন মো. শাহজাহান আনসারী। এক সময়ে কক্সবাজারের বাস টার্মিনালে পরিবহণ শ্রমিকের কাজ করা ওই ব্যক্তি মাদক কারবারের মাধ্যমে কোটিপতি হয়েছেন। অভিযোগ ছিল ৫০ কোটি টাকার মালিক তিনি। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে প্রায় তিন কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ মিলেছে।
যে কারণে সংস্থাটির করা মামলায় শাহজাহান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পত্তি ও বাড়ি-গাড়ি জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক এই আদেশ দেন।
গত ৬ জুন শুনানি শেষে কক্সবাজার আদালতের সিনিয়র স্পেশাল জজ মুনসী আব্দুল মজিদ এ আদেশ।
জব্দ করার নির্দেশ দেওয়া সম্পদ ও ভবনের মধ্যে— ঝিলংজা মৌজার বিএস ১২৯৮ নং খতিয়ানের ৭.৫০ শতক নাল জমি, সেখানে ৩তলা বিশিষ্ট একটি ভবন, ঝিলংজা মৌজার বিএস নং ১৭৪৫৯, ১৭৪৬১, ১৭৪৬৯, ১৭৪৭০ খতিয়ানের কক্সবাজারে ৪.০০ শতক নাল জমি, ঝিলংজা মৌজার বিএস ১১১৬ নং খতিয়ানের বিএস ১৩৯৭৭, ১৩,৯৮০ তৎমতে কক্সবাজার পৌরসভায় ৬.৫০ শতক জমি। এছাড়াও শাহজাহান আনসারীর ব্যবহৃত চট্টমেট্রো-(ঘ-১১-২১৬৭) নম্বরের গাড়িটিও রয়েছে। যার বাজার মূল্য ৪৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
দুদক সূত্র জানান, ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকেই ‘মৎস্য’ চাষাবাদ করে আসছেন কক্সবাজারের এ মাদক ব্যবসায়ী। গত আট বছরে এ খাত থেকে আয় করেছেন কোটি টাকারও বেশি। এসব আয় থেকে নিয়মিত কর ও দিয়ে আসছেন সরকারকে। একইসঙ্গে আয়ের টাকায় গড়েছেন সম্পদও। অথচ দুদকের অনুসন্ধানে ওঠে এসেছে- মৎস্য চাষাবাদের কোন অস্তিত্বই ‘নেই’ শাহজাহান আনসারীর। শুধু তাই নয়- এ সংক্রান্ত কোন ব্যবসা-বাণিজ্যের দালিলিক কোন রেকর্ডপত্রও পায়নি দুদক। অথচ শাহজাহান আনসারীর রয়েছে কয়েক কোটি টাকার সম্পদ। যার ৭৫ শতাংশের বেশিই অবৈধ!
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ‘ইয়াবা কারবারের’ সাথে যুক্ত থেকে এসব অবৈধ সম্পদ গড়েছেন এক সময়ের ইয়াবা কারবারি শাহাজাহান আনসারী। যার বৈধ আয়ের চেয়ে চার গুণ বেশি রয়েছে অবৈধ সম্পদ। তবে শেষ পর্যন্ত রক্ষা হলো না শাহজাহানের। অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে দুদকের মামলার জালে আটকাতে হচ্ছে এ ব্যবসায়ীকে। সঙ্গে এসব অবৈধ সম্পদ ভোগ করায় স্বামীর সঙ্গে ফাঁসতে হয়েছে স্ত্রী জিগারুন নেছা জিনিয়াকেও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত কক্সবাজারের শীর্ষ ইয়াবা কারবারি শাহজাহান আনসারীর অবৈধ সম্পদ অর্জনের খোঁজে অনুসন্ধানে নামে দুদক। প্রাথমিকভাবে তাঁর অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়ায় ২০১৯ সালে দুদকের সাবেক উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন সম্পদ বিবরণী দাখিলের জন্য কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেন। ২০২০ সালে কমিশন শাহজাহান আনসারী ও তার স্ত্রী জিগারুন নেছা জিনিয়ার নামে পৃথক সম্পদ বিবরণী দাখিলের নির্দেশ দেন। এরমধ্যে ২০১৯ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত কক্সবাজারের ১০২ মাদক কারবারি আত্মসমর্পণ করেন। যার মধ্যে শাহজাহান আনসারীও ছিলেন। মাদক মামলায় সাজা খেটে রেহাই পেলেও অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যায় দুদক।
জানা গেছে, দীর্ঘ অনুসন্ধানে শাহজাহান আনসারীর নামে প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যায়। যার মধ্যে তাঁর বৈধ পাওয়া যায় মাত্র প্রায় ৮২ লাখ টাকা। এছাড়া তার স্ত্রীর গৃহিণী হয়েও তার নামে প্রায় ১ কোটি টাকার সম্পদ অর্জন ও ভোগের তথ্য পাওয়া যায়। যার মধ্যে প্রায় ৮৫ লাখ টাকাই ছিল অবৈধ। এসব সম্পদ অবৈধ আয়ে অর্জিত বলে দুদকের অনুসন্ধানে ওঠে আসে। অর্থাৎ শাহজাহানের অর্জিত আয়ের প্রায় চারগুণ সম্পদ ছিল অবৈধ।
অন্যদিকে, কক্সবাজারে মেসার্স নুসরাত এন্টারপ্রাইজ নামীয় একটি খুচরা রড ও সিমেন্ট বিক্রির ব্যবসা রয়েছে শাহজাহান আনসারীর। বৈধ আয়গুলো ছিল এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা থেকে। এছাড়াও তার নামে সাড়ে ৪৩ লাখ টাকা মূল্যের গাড়ি থাকার তথ্য পাওয়া যায়। যার বৈধ আয়ের হিসেব দুদকের কাছে জমা দিতে পারেননি শাহজাহান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯৮ সালের দিকে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার হারবাং থেকে স্বপরিবারে চলে আসে কক্সবাজার শহরে। আশ্রয় নেন হাশিমিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন একটি ভাড়া বাসায়। কিছুদিন যেতে না যেতেই বাড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করেন ঝিলংজার পশ্চিম লারপাড়া এলাকায়। বাবা মোহাম্মদ আনসারী ছিলেন মুদি দোকানি। অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। লেখা-পড়ায় বেশি দুর যেতে পারেনি। খ্যাতি ছিল ভাল ফুটবলার হিসেবে। ফুটবল খেলে পথ চলতে চলতে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ পাওয়ার মতো অবস্থা হয় তাঁর। অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান। কাগজে-কলমে হোটেল এবং পরিবহণ ব্যবসার পাশাপাশি এলাকায় ক্রীড়াঙ্গন নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে খ্যাতিও কুড়িয়ে নেন তিনি। প্রথম প্রথম মনে হতে পারে জীবনযুদ্ধে সংগ্রাম করে উঠে আসা কোনো এক শিল্পপতির গল্প। বাস্তবতা হলো, গল্পটি মূলত আত্মস্বীকৃত ‘ইয়াবা গডফাদার’ শাহজাহান আনসারীর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি তিনি।
চকরিয়ার হারবাং; কক্সবাজার শহরের লারপাড়ায় বেড়ে ওঠা শাহজাহান আনসারীর রাজত্ব ছিল বাস টার্মিনাল, বাহারছড়া, কলাতলী ও লিংক রোডসহ কয়েকটি এলাকায়। মূলত ইয়াবা কারবারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হন তিনি। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। অবৈধ পথে অর্জিত কোটি কোটি টাকাও কাজে আসেনি শাহজাহান আনসারীর। বরং আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চোখে আসামি তিনি। ইতোমধ্যে অবৈধ সম্পদ অর্জনের দুই মামলায় আসামি হয়ে কারাভোগ করেছেন শাহজাহান আনসারী ও তাঁর স্ত্রী জিগারুননেছা জিনিয়ার। এই দম্পতির নামে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন বাদী হয়ে নিজ কার্যালয়ে এ মামলা করেন।
এজাহারে বলা হয়েছে, দুদকের অনুসন্ধানকালে সংগৃহীত নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শাহজাহানের মোট সম্পদ ৩ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ১৫৭ টাকা। এর মধ্যে জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি ৯৪ লাখ ১২ হাজার ৪৮০ টাকা। পাশাপাশি স্ত্রী জিগারুননেছার মোট সম্পদ ৮৮ লাখ ১০ হাজার ৮৯০ টাকা। এর মধ্যে জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদ ৮৫ লাখ ১৫ হাজার ৬২৫ টাকার।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ফুটবলার ও পরিবহণ কর্মচারী হিসেবে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জীবিকা নির্বাহ করে আসলেও ২০০৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুলেন এক মাদক পাচারকারী সিন্ডিকেট। এরপর থেকে তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কয়েক জনের এই সিন্ডিকেটে অন্যতম ছিলেন শাহাজাহান আনসারী। প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করতেন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া দেশের শীর্ষ ইয়াবা মাফিয়া হাজী সাইফুল করিমের। সহযোগী ছিলেন তাঁর ছোট ভাই আবু সুফিয়ান আনসারী। সিন্ডিকেটটিতে ছিল সাবেক পুলিশ সদস্য, আইনজীবী, স্থানীয় গ্রাম ডাক্তার ও বিকাশ দোকানদারসহ আরো অনেকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জানায়, মাদক কারবারিদের পুরোনো অভ্যাস কখনো বদলাবে না। ইয়াবা বেচাকেনা অনেক লাভজনক। রাতারাতি বড়লোক হওয়া যায়। আত্মসমর্পণকারীদের বেশিরভাগই পুরোনো কারবারে জড়িয়ে পড়ছে। তার ভাষ্যমতে, শাহজাহান আনসারীকে শেল্টার দিচ্ছে জেলা আ.লীগের প্রভাবশালী এক নেতা।
তথ্যসূত্রে জানা গেছে, এক সময় কক্সবাজারের ক্রীড়াঙ্গন নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে বেশ পরিচিত ছিল শাহজাহান আনসারীর। ২০১৮ সালের ১৭ অক্টোবর তাঁর বাড়িতে অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। যৌথবাহিনীর অভিযান টের পেয়ে পালিয়ে যাওয়ায় তাঁকে সেসময় আটক করতে পারেনি তারা। সরকারের পাঁচটি সংস্থার সমন্বয়ে তৈরি করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তালিকায় কক্সবাজারের ইয়াবা ডন হিসাবে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তন্মধ্যে শাহজাহান আনসারী অন্যতম। সামান্য পরিবহণ কর্মচারী থেকে ইয়াবা ব্যবসা করে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া আনসারীর কব্জায় ছিল জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। তবে আত্মসমর্পণের পর থেকে প্রভাব, প্রবৃত্তিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে।
এ বিষয়ে শাহজাহান আনসারীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
এইসব তথ্য নিশ্চিত করা দুদক কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন জানান, শাহজাহানের অবৈধ সম্পদ জব্দের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এর আগে শাহজাহান ও তাঁর স্ত্রী জিগারুননেছার বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা হয়। এর মধ্যে শাহজাহানকে উভয় মামলায় আসামি করা হলেও তাঁর স্ত্রীকে একটিতে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর