উজানের পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি হওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর-আউশকান্দি আঞ্চলিক মহাসড়কসহ ১০টি পাকা সড়ক বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। শতাধিক গ্রামের পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। অনেকেই ছুটছেন আশ্রয় কেন্দ্রে। বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক। নতুন করে দক্ষিণ কসবা গ্রামের পাকা সড়ক ভেঙে দ্রুত গতিতে বিভিন্ন গ্রামে পানি প্রবেশ করছে। সরকারিভাবে বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয়রা জানায়, কুশিয়ারা নদীর পানি বুধবার রাতে কিছুটা কমলেও বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দ্রুত পানি বৃদ্ধি পায়। বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টার দিকে কুশিয়ারা নদীর পানি শেরপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ২১, মার্কুলি পয়েন্টে ৩২ এবং আজমিরীগঞ্জে ৫৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। গত কয়েকদিন ধরে উজানের পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে কুশিয়ারা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে থাকে। এতে ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের রাজনগর, উমরপুর, মোস্তফাপুর, দক্ষিণগ্রাম, পাঠানহাটি, মনসুরপুর, দরবেশপুর, দিঘীরপাড়, নোয়াগাঁও, চন্ডিপুর, প্রজাতপুর, লামলীপাড়, দীঘলবাক ইউনিয়নের রাধাপুর, ফাদুল্লাহ, দুর্গাপুর, মথুরাপুর, হোসেনপুর, মাধবপুর, পশ্চিম মাধবপুর, গালিমপুর, আউশকান্দি ইউনিয়নের পাহাড়পুর,পারকুল, উমরপুর, দীঘর ব্রাহ্মণগ্রাম, বড় ভাকৈর (পশ্চিম) ইউনিয়নের সোনাপুর, চরগাঁও, বড় ভাকৈর (পূর্ব), করগাঁও, কালিয়াভাঙ্গা, দেবপাড়া ও কুর্শি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর-আউশকান্দি আঞ্চলিক মহাসড়কসহ ১০টি পাকা সড়ক বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে বন্ধ রয়েছে যানচলাচল। কুশিয়ারা নদী ঘেঁষা ইনাতগঞ্জ ও দীঘলবাক ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেকের ঘরবাড়িতে প্রবেশ করছে। ফলে মানবেতর অবস্থায় জীবনযাপন করছে সাধারণ মানুষ। সময়ের সাথে সাথে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। এমন অবস্থায় বন্যা কবলিতরা আশ্রয় কেন্দ্র ছুটছে। ১৪টি আশ্রয় কেন্দ্রের মধ্যে ৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৩শ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে সরকারি খাদ্য সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরের পর দীঘলবাক ইউনিয়নের দক্ষিণ কসবা গ্রামের পাকা সড়ক ভেঙে দ্রুত গতিতে বিভিন্ন গ্রামে পানি প্রবেশ করছে। এতে মানুষ আতঙ্কে উৎকণ্ঠায় জীবনযাপন করছে। বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ইনাতগঞ্জ অবস্থিত শেভরন পরিচালিত এশিয়া মহাদেশের অন্যতম গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানা ও পারকুলে অবস্থিত কুশিয়ারা নদী ঘেঁষা বিবিয়ানা ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে। বিবিয়ানা গ্যাস ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হতে ৪-৫ ফুট নিচে বর্তমান পানি রয়েছে। তবে দ্রুতহারে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্যাসক্ষেত্রে পানি প্রবেশের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
গতকাল বিকেলে হবিগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী, হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক জিলুফা সুলতানা, হবিগঞ্জ পুলিশ সুপার আক্তার হোসেন বিপিএম, নবীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান চৌধুরী শেফু , নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনুপম দাশ অনুপ, উপজেলা ভাইস চেয়রম্যান সাইফুল জাহান চৌধুরী সরেজমিনে ইনাতগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্র, ইনাতগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্র ও দীঘলবাক ইউনিয়নের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পরিদর্শন করেছেন।
ইনাতগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়া রফিক মিয়া জানান- বন্যার পানিতে বাড়িঘর শেষ, ঘরে কোমর সমান পানি, পরিবার নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছি, কিন্তু এখনো কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাইনি।
এই আশ্রয় কেন্দ্রে আসা সোহেনা বেগম বলেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত খাবার কিচ্ছু নেই, অসহায় অবস্থায় দিনযাপন করছি।
শেভরন বাংলাদেশের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের কমিউনিকেশন ম্যানেজার শেখ জাহিদুর রহমান বলেন, বন্যার পানি যাতে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে প্রবেশ না করে এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি আছে। তিনি- পানি প্রবেশের কোনো শঙ্কা নেই বলে জানান।
নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনুপম দাশ অনুপ জানান, বন্যা কবলিত এলাকার লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে এসে আশ্রয় নেওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়েছে। ১৪টি সরকারি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র খোলা রয়েছে, এরমধ্যে ৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৩ শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।
হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ জানান, কুশিয়ারা নদীর পানি বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দ্রুত পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিকেল ৩টার দিকে কুশিয়ারা নদীর পানি শেরপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ২০ মার্কুলি পয়েন্টে ৩২ এবং আজমিরীগঞ্জে ৫৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিনি বলেন- কুশিয়ারা ডাইক মেরামতের জন্য সরকারি ভাবে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। নদীর বাঁধ রক্ষায় চার হাজার জিও ব্যাগ ও ১২ হাজার সিনথেটিক ব্যাগ মজুদ করা হয়েছে।
হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক জিলুফা সুলতানা জানান, বন্যা কবলিত মানুষদের আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হচ্ছে, যারা আশ্রয় কেন্দ্রে আছেন, তাদের সবাইকে পর্যায়ক্রমে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হবে, আমরা সবসময় বন্যার্ত মানুষের পাশে আছি।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর