প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাস করেও অদম্য ইচ্ছা শক্তিকে যে কাজে লাগানো যায় সেই চিন্তা থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি মিশ্র ফল বাগান করে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বগুড়া জেলার নন্দীগ্রাম উপজেলার ৩নং ভাটরা ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের উজ্জ্বল আহমেদ নামে এক যুবক। হয়েছেন সফল উদ্যোক্তাও।
পড়াশোনা শেষ করে চাকুরির পিছনে না ছুটে ইউটিউব দেখে শিক্ষা নিয়ে নিজের পরিশ্রম ও মেধায় ৫বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন মিশ্র ফলের বাগান।
এই উজ্জ্বল আহমেদের সফলতার গল্প জানতে এই প্রতিবেদক ছুটে যায় তার মিশ্র ফল বাগানে। সেখানে গিয়ে দেখা যায় সারি সারি করে লাগানো হয়েছে হরেক রকমের মিশ্র ফলের গাছ। উজ্জ্বল আহমেদের মিশ্র ফল বাগানের সফলতার গল্প জানতে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, আমি আমার গ্রামের স্কুল থেকে শিক্ষা জীবন শুরু করি। এরপর বগুড়া সরকারি আজিযুল হক কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ২০২৩ সালে মাস্টার্স শেষ করি। বাড়ি থেকে তেমন একটা আর্থিক সহায়তা না পেলেও উজ্জ্বল শিক্ষাজীবনে টিউশনি করেই নিজের খরচ ও পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন। একসময় সারাদেশে যখন করোনা মহামারি আকার ধারণ করে তখন সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় উজ্জ্বলের টিউশনিও বন্ধ হয়ে যায়। চিন্তায় পড়ে যায় কি করবেন এখন। ঠিক সেই মুহূর্তে উজ্জ্বলের চোখে পড়ে যায় শেখ সিরাজের মিশ্র ফল বাগান নিয়ে করা একটি প্রতিবেদন। ঠিক তখনি তিনি পরিকল্পনা করেন একটি মিশ্র ফল বাগান করার।
করোনাকালীন সময়ে ঘরে বসেই ইউটিউবে দেখতে থাকেন মিশ্র ফল বাগানের নানা ধরনের ভিডিও। ছুটে আসেন নিজ গ্রামে, পরিকল্পনা করেন মিশ্র ফল বাগান করার। পরিবারের সাথে মিশ্র ফল বাগান করার পরিকল্পনা জানান উজ্জ্বল, কিন্তু একজন মেধাবী কলেজ পড়ুয়া ছাত্র শিক্ষাজীবন শেষ করে এসে চাকুরি না করে করবে ফল বাগান, উজ্জ্বলের এমন উদ্যোগকে মেনে নেয়নি তার বাবা আব্দুল খালেক সহ তার পরিবার। উজ্জ্বল পরিবারের থেকে কোন আর্থিক সহায়তা না নিয়েই টিউশনি করা ১২শ টাকা দিয়ে ৪০টা চায়না-৩ জাতের বারোমাসি লেবুর চারা ক্রয় করে বাড়ির পাশে ৫ শতক জমিতে রোপণ করেন।
এরপর তিনি সন্তানের মত গাছ গুলোর পরিচর্যা করতে থাকেন। একসময় এই ৪০টা গাছ থেকে লেবু বিক্রয় করে লাভবান হোন পাশাপাশি লেবুর গুটি কলম বিক্রিও শুরু করেন। এরপর আর তার পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর উজ্জ্বল আহমেদ ছুটে যান নন্দীগ্রাম উপজেলা কৃষি অফিসে। সেখানে পরিচিত হয় উপসহকারী কৃষি অফিসার নাজমুল হোসাইনের সাথে। নাজমুল হোসেন তাকে কৃষি বিষয়ক পরামর্শ প্রদান সহ সার-বীজ এমনকি আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেন। তিনি কৃষি অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী ৫বিঘা জমিতে ৩লক্ষ টাকা খরচ করে দার্জিলিং কমলা, ভিয়েতনামী মাল্টা, চায়না কমলা, আফ্রিকান হলুদ মাল্টা, সিডলেস লেবু, নেপালী সাগর কলা, রংবিলাস আঁখ, ফিলিপাইন ব্লাক আখ বলসুন্দরী কুল সহ প্রায় ২০ প্রজাতির ফল গাছ রোপন করেন।
এখন উজ্জ্বল আহমেদ সে সব ফল গাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার ফল বিক্রয় করছেন। পাশাপাশি তিনি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে চারা বিক্রি করেন। পাঁচ বিঘা জমিতে তার খরচ হয় ৩লক্ষ টাকা। এবং ওই পাঁচ বিঘা জমি থেকে উজ্জ্বলের বাৎসরিক আয় ৬ থেকে ৭ লক্ষ টাকা। আরোও নতুন করে পাঁচ বিঘা জমিতে ফিলিপাইন বøাক আঁখ ও নেপালি সাগর কলা ও নার্সারি করার জন্য জায়গা প্রস্ততি চলছে। উজ্জ্বল আহমেদের ফার্মের নাম স্বপ্ন অংঙ্কুর অ্যাগ্রো ফার্ম এন্ড নার্সারি। তার নার্সারিতে রয়েছে প্রায় দেড়শ প্রজাতির ফলের চারা। তিনি এখন হয়েছেন বড় মাপের একজন কৃষি উদ্যোক্তা। তার নার্সারির ফলের চারা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তার ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজের নাম স্বপ্ন অংঙ্কুর অ্যাগ্রো ফার্ম। প্রতিদিন তার চ্যানেলে কৃষি বিষয় প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। উজ্জ্বল আহমেদের মাধ্যমে সারা দেশে অনেক নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে।
উজ্জ্বল আহমেদ আরো জানান, চারা থেকে এখন আমি প্রতি মাসে ১লক্ষ টাকা আয় করছি এছাড়াও চারা ও ফল বাগান থেকে প্রতিবছর ৬থেকে ৭লক্ষ টাকা আয় করছি। আমার এমন উদ্যোগ দেখে আশেপাশের অনেক বেকার যুবকেরা মিশ্র ফল বাগান করার জন্য আমার কাছে পরামর্শ নিতে আসছে। আমার এসব ফল গাছ গুলো থেকে আগামী ২০ বছর পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করা যাবে। সব মিলিয়ে এই মিশ্র ফল বাগান করে এখন আমি অনেক স্বাবলম্বী।
জানতে চাইলে উপজেলা সহকারী কৃষি অফিসার নাজমুল বলেন, উজ্জ্বল আহমেদ আমার দেখা একজন পরিশ্রমী কৃষি উদ্যোক্তা আমি শুরু থেকে তাকে মিশ্র ফল বাগান করার জন্য সকল ধরনের পরামর্শ সহ সার্বিক সহযোগিতা করেছি, এবং সবসময় তার মিশ্র ফল বাগানে পরিদর্শন করি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গাজীউল জানান, আমার নন্দীগ্রামে যদি কোন কৃষি উদ্যোক্তা থেকে থাকে সেটি হচ্ছে উজ্জ্বল আহমেদ, তিনি অনেক পরিশ্রম করে আজ একজন বড় কৃষি উদ্যোক্তা হয়েছেন। উজ্জ্বল আহমেদ তার মিশ্র ফল বাগান থেকে প্রতিবছরে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করছে।কৃষি অফিস থেকে তাকে সকল ধরনের পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে, আমরা সবসময় তার পাশে রয়েছি।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর