সাবেক ও বর্তমান প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনে বিব্রত বাংলাদেশের মানুষ। পুলিশ জনগণের বন্ধু। পুলিশের কাজ জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা দেয়া। সেখানে পুলিশের কর্তা ব্যক্তিরাই দুর্নীতি করে জনগণের টাকা লুট করে হয়েছেন অঢেল সম্পত্তির মালিক। অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে নষ্ট করেছেন সমাজ ব্যবস্থা। পুলিশের কর্তা ব্যক্তিদের এহেন কর্মকাণ্ডে বিশ্বের কাছে ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশের।
গত মার্চ মাসে কালেরকণ্ঠ পত্রিকায় বেনজিরকে নিয়ে প্রথম প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেখানে দাবি করা হয়, পুলিশের সাবেক প্রভাবশালী শীর্ষ কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদের স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ছয়টি কোম্পানির খোঁজ পাওয়া গেছে৷ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে৷ প্রতিবেদনে আরো দাবি করা হয় ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোতে বেনজীর আহমেদের দামি ফ্ল্যাট, বাড়ি আর ঢাকার কাছের এলাকায় বিঘার পর বিঘা জমি রয়েছে৷ দুই মেয়ের নামে বেস্ট হোল্ডিংস ও পাঁচতারা হোটেল লা মেরিডিয়ানের রয়েছে দুই লাখ শেয়ার৷ পূর্বাচলে রয়েছে ৪০ কাঠার সুবিশাল জায়গাজুড়ে ডুপ্লেক্স বাড়ি, যার আনুমানিক মূল্য কমপক্ষে ৪৫ কোটি টাকা৷ একই এলাকায় আছে ২২ কোটি টাকা মূল্যের আরো ১০ বিঘা জমি৷ অথচ ৩৪ বছর সাত মাসের দীর্ঘ চাকরিজীবনে বেনজীর আহমেদ বেতন-ভাতা বাবদ মোট আয় এক কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকার মতো হওয়ার কথা৷
বেনজীর আহমেদ বাংলাদেশ পুলিশের একজন সাবেক কর্মকর্তা যিনি পুলিশের ৩০তম মহাপরিদর্শক ছিলেন। তিনি ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপূর্বে তিনি র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যা ব) এর মহাপরিচালক এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
চলতি মাসে দৈনিক মানবজমিনে পুলিশের সাবেক কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় সেখানে বলা হয়, বাড়ির পর বাড়ি। জমি এবং ফ্ল্যাটের সারি। কী নেই সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান মিয়ার। রীতিমতো গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। তবে শুধু নিজের নামে নয়। স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ের নামেও বিপুল সম্পত্তি গড়েছেন ডিএমপি’র সাবেক এই কমিশনার। অনুসন্ধানে তথ্য-প্রমাণ মিলেছে আছাদুজ্জামান মিয়া ও তার পরিবারের সম্পদের পাহাড়ের। অনেক সম্পদের নথিও এসেছে তাদের হাতে। সরজমিন যার সত্যতা মিলেছে।
পূর্বাচলের নিউ টাউনের ১ নম্বর সেক্টরের ৪০৬/বি রোড। এখানে ১০ কাঠা জমি রয়েছে আছাদুজ্জামানের নামে। পূর্বাচলের এই প্লটের প্রতি কাঠা জমির মূল্য এক কোটি টাকারও বেশি। পূর্বাচলের সেক্টর ৪, রোড ১০৮-এ ৫৩ নম্বর প্লটটি আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর নামে ছিল। ৫ কাঠার এই প্লটটি বিক্রি করে দেয়া হয়েছে।
আফতাবনগর ৩ নম্বর সেক্টরের, এইচ ব্লকের ৮ নম্বর রোড দিয়ে প্রবেশ করলে স্থানীয় মসজিদের সামনে বাউন্ডারি দেয়া ৩৬ নম্বর প্লটে ২১ কাঠা জমি রয়েছে। এই প্লটটিও আছাদুজ্জামান মিয়ার। এই প্লটটি ৮ নম্বর রোডের সবচেয়ে বড় প্লট। এখানে প্রতিটি প্লট সর্বোচ্চ ৫ কাঠা ও তার সামান্য কিছু বেশি।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এল ব্লকের লেন-১ এ ১৬৬ এবং ১৬৭ নম্বরে ১০ কাঠার উপর ৬ তলাবিশিষ্ট আলিশান বাড়িটি আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর নামে। বাড়িটি বর্তমানে ভাড়া দেয়া। যা স্কুল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাড়িটির বাজার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। নিকুঞ্জ-১ এর ৮/এ রোডের ৬ নম্বর বাড়িটি আছাদুজ্জামানের ছোট ছেলে আসিফ মাহাদীনের নামে। সম্প্রতি তারা বাসার নেমপ্লেট খুলে রেখেছেন। কেন রেখেছেন জানি না। বাড়িটির মূল্য ১০ কোটি টাকার বেশি।
সিদ্ধেশ্বরী রূপায়ন স্বপ্ন নিলয় ৫৫/১-এর বহুতল ভবনে ৩ নম্বর ভবনে ৩ হাজার ৮শ’ থেকে ৪ হাজার স্কয়ার বর্গফিটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে আছাদুজ্জামানের মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকার নামে। আয়েশা সিদ্দিকা বর্তমানে এই বাসায় নেই। ফ্ল্যাটটি তার নামে রয়েছে। ইস্কাটন গার্ডেন ১৩/এ প্রিয়নীড়ে আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ফ্ল্যাটটি বর্তমানে ফাঁকা পড়ে আছে। কেউ থাকেন না। ধানমণ্ডির ১২/এ সড়কের ৬৯ নম্বর বাড়ির বি/২/৫ ভবনটিতে এককাঠা জমিসহ আছাদুজ্জামান মিয়ার পরিবারের সদস্যদের নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ৬ তলাবিশিষ্ট ভবনটিতে ২০টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এখানে ফ্ল্যাটের মূল্য ৩ থেকে সাড়ে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত। ভবনটি খালি পড়ে আছে।
অন্তত দু’টি কোম্পানির খোঁজ পাওয়া গেছে আছাদুজ্জামান ও তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানার। আছাদুজ্জামান মিয়ার স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে ঢাকা, ফরিদপুর ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জমির সন্ধান মিলেছে। ২০১৮ সালে তিনি রাজউক থেকে একটি প্লট বিশেষ কোটায় বরাদ্দ পান। অথচ রাজউকের নীতিমালা অনুযায়ী, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের প্লট বরাদ্দ পাওয়ার সুযোগ নেই। ঢাকার গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার চাঁদখোলা মৌজায় আফরোজা জামানের নামে ৪১ শতাংশ জমি রয়েছে। যা কেনা হয়েছে ২০১৭ সালে। একই মৌজায় একই বছরের ১৬ই নভেম্বর তার নামে কেনা হয় আরও ২৬ শতাংশ জমি। একই মৌজায় তার নামে ২০১৯ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি কেনা হয় আরও ৩৯ শতাংশ জমি।
আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর নামে ২০২০ সালে জোয়ার সাহারা মৌজায় ৫ কাঠা জমি কেনা হয়। একই বছরে একই মৌজায় কেনা হয় ১০ কাঠা জমি। একই বছরে গাজীপুরের চাঁদখোলা মৌজায় ৩১ শতক জমি ক্রয় করেন আফরোজা। এ ছাড়া আফরোজা ২০১৮ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইল- কায়েতপাড়া মৌজায় দশমিক ২৮ একর জমি কেনেন। একই বছরে একই মৌজায় আরও ৩২ শতক জমি কেনেন তিনি। ওই বছরই রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় দশমিক ৬০ একর জমি তার নামে কেনা হয়। পরে তা বিক্রি করে দেয়া হয়। এ ছাড়াও ২০১৯ সালে কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় দশমিক ৫৭ একর জমির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি পান আছাদুজ্জামানের স্ত্রী। একই বছরে আবার সেই জমি বিক্রিও করেন। দুটি কোম্পানির অংশীদার হয়েছেন আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা। এর মধ্যে একটি মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান তিনি। এ কোম্পানিতে তার চার হাজার শেয়ার রয়েছে। আসাদুজ্জামান ডিএমপি কমিশনার থাকাকালীন রাজধানীর রুট পারমিট কমিটির প্রধান ছিলেন। সে সময় মৌমিতা পরিবহনকে রুট পারমিট দেয়া হয়।
এই মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান হারিসুর রহমান সোহান। তিনি আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের সৎ ভাই। এক সময় তিনি লেবার ভিসায় সৌদি যান। পরে দেশে এসে ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে রাজধানীর নিউমার্কেটে তাদের নিজস্ব জুয়েলারি দোকান রয়েছে। এ ছাড়া শেপিয়ার্ড কনসোর্টিয়াম লিমিটেড নামে আরেকটি কোম্পানির চেয়ারম্যান আফরোজা জামান। এই কোম্পানির পরিচালক আছাদুজ্জামানের বড় ছেলে আসিফ শাহাদাত।
আছাদুজ্জামানের এক শ্যালক নূর আলম ওরফে মিলন। তার নামে গাজীপুরের শ্রীপুরে দেড় একর জমি রয়েছে। ভাগ্নে কলমের নামেও গাজীপুরে জমি আছে দেড় একর। অথচ আজীবন গ্রামে থাকা মিলনের নির্দিষ্ট কোনো আয় নেই। অন্যদিকে ভাগ্নে কলমও গ্রামের বাসিন্দা। তিনি বনে গেছেন কয়েক কোটি টাকা দামের জমির মালিক। এই কলম আবার আছাদুজ্জামানের গ্রামের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক।
সিভিল সার্ভিস ক্যাডারের ৮৫ ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে যান। পরে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০২২ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর তার নিয়োগের ৩ বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। আছাদুজ্জামান মিয়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৩৩তম কমিশনার ছিলেন।
এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন আলোচিত চিত্রনায়িকা পরীমনির সাথে সম্পর্কের জের ধরে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গোলাম সাকলায়েনকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের পরামর্শ চাওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি চিঠি পাঠিয়েছে সরকারি কর্ম কমিশনে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন বেশ আলোচনা চলছে।
গত ১৩ই জুন ইস্যু করা চিঠিতে বলা হয়েছে, পুলিশ কর্মকর্তা গোলাম সাকলায়েন ও চিত্রনায়িকা পরীমনির মধ্যে অনৈতিক প্রেমের সম্পর্ক ছিল এবং তিনি নিয়মিত পরীমনির বাসায় রাত্রিযাপন শুরু করেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, ঢাকায় কর্মরত অবস্থায় নায়িকা পরীমনির সাথে গোলাম সাকলোয়েনের ঘটনাক্রমে দেখা হয় এবং যোগাযোগ আরম্ভ হয়।
২০২১ সালে ঢাকার উত্তরায় অবস্থিত বোট ক্লাবে বিতণ্ডার জেরে ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদের বিরুদ্ধে চিত্রনায়িকা পরীমনি মামলা করেন।
তখন বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলোচনার সূত্রপাত হয়। একপর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তা গোলাম সাকলায়েনের সাথে পরীমনির জন্মদিন উদযাপন করার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
সাকলায়েন তখন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
ভিডিও ছড়িয়ে যাবার পর সাকলায়েনকে সেখান থেকে বদলি করা হয়। সর্বশেষ তিনি ঝিনাইদহ জেলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টার-এ কর্মরত ছিলেন।
পুলিশের কর্তা ব্যক্তিদের এতো দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনের পরও তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কার্করী কোন পদক্ষেপ নেননি সরকার। এরই মধ্যে বেনজির আহমেদ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। এদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে এসব সরকারী কর্তা ব্যক্তিদের অন্যায় দিন দিন আরও বাড়বে। তাই সরকারের উচিত দ্রুত এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। এটিই সরকারের কাছে জনগণের চাওয়া।
মাসউদুর রহমান
লেখক ও সাংবাদিক।
সর্বশেষ খবর