২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে মানববন্ধন, সড়ক অবরোধসহ কঠোর আন্দোলন করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সরকারের মন্ত্রিসভা ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে।
চলতি বছরের ৫ জুন মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলসংক্রান্ত সেই পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট। এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এবং চাকরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ বহাল রাখার দাবিতে’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবারও বিক্ষোভ করে। কোটা বাতিলের জন্য আল্টিমেটাম দিয়ে পহেলা জুলাই থেকে কঠোর আন্দোলনের হুশিয়ারিও দেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা৷ তাই কোটা নিয়ে আমরা জানতে চায় বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতামত। যা তুলে ধরছেন বিডি২৪লাইভডটকমের যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি শেখ সাদী ভূঁইয়া।
'মুক্তিযোদ্ধারা অনগ্রসর জনগোষ্ঠী না, তাই তাঁদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা রাখা সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়'
রিয়া মোদক
শিক্ষার্থী, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশ সরকার কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিল। কিন্তু বর্তমানে হাইকোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে আবার কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা থাকায় অনেক মেধাবীরা সুযোগ পাচ্ছেনা। ফলে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। চাকরিপ্রত্যাশীরা বলছেন, ৫৬ শতাংশ কোটা অযৌক্তিক। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যও কোটা প্রথাকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অসম্মানজনক হিসেবে মনে করছেন। কেউ কেউ আবার মনে করেন কোটা না থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অসম্মান। সব মিলিয়ে কোটার পক্ষে-বিপক্ষে চলছে নানা যুক্তিতর্ক। যদিও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুক্তিযোদ্ধারা অনগ্রসর জনগোষ্ঠী না। তাই তাঁদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা রাখা সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তারা বলেন, নারী, প্রতিবন্ধী, দলিত, চা-শ্রমিকসহ পার্বত্য ও উপকূলীয় এলাকার অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা রাখা যেতে পারে। তবে তা কখনই মেধার অংশের চেয়ে বেশি হতে পারে না।
'কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত দেশকে মেধাহীন করার একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে'
এইচ এম খালিদ
শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মাননীয় আদালত কর্তৃক কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত দেশকে মেধাহীন করার একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। একটি দেশের সরকারি চাকরিতে মেধাবীরা যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে প্রবেশ করবে। কিন্তু এই রায়ের ফলে মেধাহীনরাও কোটা বলে সেখানে প্রবেশ করবে। কেউ পরীক্ষায় ৯০ পেয়েও সুযোগ পাবে না আবার কেউ কোটার বলে ৬০ পেয়েও চাকরি পেয়ে যাবে। ফলে দেশটা একসময় মূর্খ লোকদের দ্বারা শাসিত হবে যা দেশের ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত। একটি দেশকে স্বাধীন করতে অংশগ্রহণকারী ও প্রাণ বিসর্জনকারী বীরদের মাসিক সহায়তা বা তার পরিবারকে মাসিক সহায়তা দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিনারের স্বচ্ছলতার জন্য সরকারের সর্বাত্মক চেষ্টা করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। তবে মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছরে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের চাকরিতে প্রবেশে ৩০ শতাংশ কোটা দেওয়া হচ্ছে এটা মেধাবীদের প্রতি অন্যায়ের শামিল। তবে সেটা রাখতে চাইলেও সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ রাখা যেতে পারে। বর্তমানে নারীরা সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় টপার হিসেবে নারীরা পুরুষদের থেকে অনেক এগিয়েই আছে। সেখানে তাদের আলাদা কোটা দেওয়ার কারণ দেখি না। কোটা দরকার গ্রামের অবহেলিত মেয়েদের কিন্তু তারা সেটার ফলভাগী না। ফল ভোগ করছে শহুরে বা সেসব মেয়েরা যারা সকল সুবিধা নিয়েই বড় হয়েছে। ফলে নারীরা সুবিধাবঞ্চিত বলে কোটা চালু রাখার সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। জেলা কোটার ফলেও মেধাবীদের বঞ্চিত করে সেই জেলা থেকে কম মেধাবীদের নিয়োগ দেওয়া হবে যা একদমই উচিত নয়। এতে মেধাবীরা পড়াশোনা ও পরবর্তীতে কাজের স্পৃহা হারিয়ে ফেলবে।তবে আমি মনে করি প্রতিবন্ধী কোটা ও উপজাতি কোটা রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে উপজাতি কোটা ৫ শতাংশ থেকে নামিয়ে ১-২ শতাংশ করা যেতে পারে। ফলে তুলনামূলক অবহেলিত এসব সম্প্রদায় দেশের নেতৃত্ব বা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আসতে পারবে৷
'জাতি এবং দেশের সার্বিক স্বার্থে কোটা সংস্কার এখন সময়ের দাবি'
সাদিয়া আফরিন অমিন্তা
শিক্ষার্থী, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম বিভাগ
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে দ্বিমত সৃষ্টি হয়েছে। পুরো জাতিকে নতুন কর ভাবনায় ফেলেছে এই কোটা শতাংশ সংখ্যা। সাথে সরকারের চুলচেরা বিশ্লেষণও করছে সাধারণ নাগরিক। একটি দেশের সুনাগরিক হওয়ায় সবার আগে দেশের স্বার্থ রক্ষা করাটা জরুরি মনে করে বলছেন, মুক্তিযোদ্ধারা নিঃসন্দেহে এ দেশের শ্রেষ্ঠ এবং বীর সন্তান। তাদের পরিবারকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে কোনো দেশপ্রেমিক দ্বিমত নেই। কিন্তু যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে, সেটা দেশের বৃহৎ স্বার্থে বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন সাধারণ নাগরিক। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৯(১)-এ বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ- লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’ তবে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারেও বলা আছে। সংবিধানটির দিকে একটু দৃষ্টিপাত করলে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে যে, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা কি আসলেই অনগ্রসর? যদি উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয় তবে, এটা আমাদেরই দেশের জন্য লজ্জাজনক বিষয় ছাড়া আর কিছুই নয়। অপরদিক বিবেচনা করলে একজন মুক্তিযোদ্ধার পরিবারে সদস্য সংখ্যা সর্বনিম্ন ১০-১৫ জন ধরা যাক। এখন বিষয়টি লক্ষ করলে দেখা যাচ্ছে একজনের পেছনে এতজন লোক রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা যেমন বিভিন্ন ভাতা, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ অন্যান্য সুবিধা ভোগ করছে। এর পরও যদি মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদের বিশেষ সুবিধা দরকার হয়, তাহলে সেটা প্রকৃত অর্থেই যারা অনগ্রসর তাদের অধিকার নষ্ট করা ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়। তাই বলে প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখায় সাধারণ ও প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীদের করা হচ্ছে বঞ্চিত। বিসিএসের মতো পরীক্ষায় প্রায় ৫৬% নিয়োগ কোটার ভিত্তিতে হচ্ছে। সাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য মাত্র ৪৪%। এ পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে দেশের বিপুল সংখ্যক মেধাবীকে হতাশ করছে বা ভবিষ্যতেও করবে। এখানে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ পুরো জাতির এবং দেশের সার্বিক স্বার্থেই কোটা সংস্কারের এখন সময়ের দাবি।
'চাকুরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পুনরায় বিবেচনা করা উচিত'
রানা আহম্মেদ অভি
শিক্ষার্থী, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
সরকারি চাকরিতে একটি বড় অংশ কোটা অন্তর্ভুক্ত; যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতকে স্বাভাবিকভাবে আহত করবে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সূর্য সন্তান; আমরা সবাইকে সম্মান জানাই। তবে সিংহভাগ চাকুরিতে মেধাবীদের বাদ দিয়ে কোটার মাধ্যমে তাঁদের নাতি-নাতনিদের নিয়োগ দেওয়া হবে; যা বৈষম্যের সমতুল্য। কম পরিশ্রম করে বড় অংশ চাকুরি লুটে নিবে; এটা জনসাধারণের জন্য মেনে নেওয়া কষ্টকর। তাই চাকুরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পুনরায় বিবেচনা করতে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। নিপীড়ন মূলক সিদ্ধান্তের ফলে প্রকৃত মেধাবী ও পরিশ্রমীরা চাকরি পাবে না।
'নিপীড়ন মূলক সিদ্ধান্তের ফলে প্রকৃত মেধাবী ও পরিশ্রমীরা চাকরি পাবে না'
আরিফ হোসাইন
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।
সরকারের ইশারায় হাইকোর্ট সকল ধরনের কোটা বহালের যে রায় দিয়েছে তা অসাংবিধানিক ও দেশকে মেধা শূন্য করার করার হীন চক্রান্ত, এটা এখন সকলের কাছেই পরিষ্কার। এই ধরনের নিপীড়ন মূলক সিদ্ধান্তের ফলে প্রকৃত মেধাবী ও পরিশ্রমীরা চাকরি পাবে না, ফলে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হবে। ফলে দেশ হবে মেধা শূন্য এবং দেশ পরিচালনায় থাকবে অযোগ্য ও অদক্ষ লোকজন। দেশে এমনিতেই প্রকৃত মেধাবীরা চাকরি পাচ্ছে না, দিনে দিনে বাড়ছে বেকারত্বের হার। তারপর এই ধরনের নিপীড়নমূলক রায় দেশের শিক্ষিত তরুণ-যুবকদের জন্য কতটা ভয়াবহ হবে সরকারের সেটা ভাবা উচিত ছিল। আমি মনে করি, সংবিধানে প্রতিবন্ধী কোটা ছাড়া অন্য কোনো কোটা থাকার কোনো যৌক্তিকতা নেই। সেজন্য সংবিধান সংশোধন করার প্রয়োজন করা হলে তাই করা উচিত। কেননা সংবিধান জনগণের জন্য ও সংশোধনযোগ্য। কোটা আন্দোলন এখন শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি ও জীবন-মরণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে, কোটা পদ্ধতির কবর না দিয়ে ঘরে ফিরবো না।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর
ক্যাম্পাস এর সর্বশেষ খবর