রপ্তানির ভুল তথ্য দেখিয়ে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। শনিবার (৬ জুলাই) ঢাকায় বিটিএমএ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনটির সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন এ কথা জানান।
এ সময় বিটিএমএর সহ-সভাপতি মো. ফজলুল হক, মোহাম্মদ ফায়জুর রহমান ভুঁইয়াসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
রপ্তানি তথ্যে গরমিলের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া প্রসঙ্গে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, জাতীয় রপ্তানি কমিটিকে আমরা প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলাম বিজিএমইএ ইউডি (ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন: কাঁচামাল ব্যবহারের ঘোষণা) ও আমাদের প্রডাকশন ডাটার সঙ্গে রপ্তানির ডাটার মিল নেই।
সেখানে গভর্নর মহোদয় এবং অন্যান্য লোক আমাদেরকে ধমক দিয়ে বলেন, আমরা বলি আমাদের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে আর আপনারা বলেন কম। এতে বিজিএমইএ সভাপতিসহ আমরা যারা ছিলাম তারা নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলি। সেটা দেখিয়েই সরকার বলছে যে আমাদের গ্রোথ বাড়ছে। এ গ্রোথের কথা বলে আমাদের ফ্যাসিলিটিগুলো আসলে কাট করা হয়েছে। আমি বলব এটা এক ধরনের ষড়যন্ত্র। মিথ্যা তথ্যের গ্রোথ দেখিয়ে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করা করেছে, আমরা উপকৃত হইনি।
সব ধরনের রপ্তানির দ্বিতীয়বারের নগদ সহায়তা কমিয়ে গত ৩০ জুন প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এলডিসি গ্রাজুয়েশনের অজুহাতে এ প্রণোদনা কমানো হয়। এতে তৈরি পোশাক, চামড়া, পাট, কৃষিসহ ৪৩ খাতে নগদ সহায়তা কমবে রপ্তানিকারকদের। প্রণোদনা কমানোর এ সিদ্ধান্তও প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। পাশাপাশি দ্রুত সময়ের মধ্যে টেক্সটাইল শিল্পের জন্য একটি যুগোপযোগী টেক্সটাইল পলিসি প্রণয়ন এবং ব্যাংক লোন পরিশোধের জন্য এক বছরের গ্রেস পিরিয়ড রাখার দাবি জানিয়েছে বিটিএমএ।
মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, যেকোনো শিল্প শক্তিশালী বা টেকসই করার জন্য নীতি সহায়তা বা প্রণোদনা প্রয়োজন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও যা দিয়ে আসছে। যেকোনো দেশের জন্য টেকসই শিল্প প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন শক্তিশালী নীতি সহায়তা ও প্রণোদনা। আমাদের দেশে কোনো ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা না রেখে নগদ প্রণোদনা যেভাবে কমানো হয়েছে, তাতে টেক্সটাইল সেক্টরে সক্ষমতা কমবে। এর প্রভাবে ক্রমান্বয়ে এ সেক্টরের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। এছাড়া এ খাতে প্রতিযোগী অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমরা কোনোভাবেই টিকতে পারব না। কোনো কারণে প্রাইমারি টেক্সটাইল বন্ধ হলে পরবর্তীতে তৈরি পোশাক শিল্পও ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে। এতে দেশের অর্থনীতিতে ধস নামার আশঙ্কা তৈরি হব।
তিনি বলেন, ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তুলা উৎপাদনকারী দেশ এবং টেক্সটাইল টেকনোলজিতেও বিশ্বে দ্বিতীয়। ভারত বর্তমানে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ এবং ২০০৪ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েটেড হওয়া সত্ত্বেও টেক্সটাইল শিল্পকে নানানভাবে নগদ প্রণোদনার বিকল্প সুবিধা দিয়ে আসছে। সুতরাং এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের নামে বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পের প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা ব্যাপকভাবে কমিয়ে এ শিল্পে যেভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে, তাতে এ শিল্প অচিরেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবে।
বিটিএমএ সভাপতি বলেন, প্রতি অর্থবছরে বস্ত্র ও পোশাক খাতে রপ্তানির বিপরীতে মাত্র ৮ হাজার কোটি টাকা নগদ প্রণোদনা দেয় সরকার। এটি দেশের প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার জাতীয় বাজেটের তুলনাই খুবই সামান্য। এর বিপরীতে বিপুল পরিমাণ রপ্তানি আয়ে অবদান রাখছে বস্ত্র ও পোশাক খাত। কিন্তু সম্প্রতি বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানির বিপরীতে প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা ব্যাপকভাবে কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটি বাস্তবায়িত হলে তা এ দুটি খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
টেক্সটাইল খাতে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে জানিয়ে মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, পরোক্ষভাবে প্রায় এক কোটি জনগোষ্ঠী এ খাতের ওপর নির্ভরশীল। যারা প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের টেক্সটাইল শিল্প সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে এবং নানামুখী চাপ প্রয়োগ করে এ শিল্পকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছেন, তারা আসলে এ দেশকে বিদেশি বাজারে পরিণত করতে চায়।
তিনি আরো বলেন, জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পাস হয়েছে। এ বাজেটে টেক্সটাইল ও অ্যাপারেল খাতের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো পলিসি সাপোর্ট এবং এই খাত সুরক্ষায় কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
বিটিএমএ সদস্যরা চাহিদার শতভাগ সরবরাহ করতে সক্ষম হলেও চোরাইপথে দেশীয় চাহিদার প্রায় ১৫ শতাংশ কাপড়ের অনুপ্রবেশ ঘটছে বলে অভিযোগ তোলেন বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন। তিনি বলেন, এতে সরকার প্রচুর রাজস্ব হারাচ্ছে। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হচ্ছে।
মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে প্রতিবছর ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন মিটার ফেব্রিক বা কাপড়ের চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে কাপড়ের চাহিদা রয়েছে ৭ বিলিয়ন মিটার। প্রতি মিটার কাপড়ের মূল্য ২ ডলার হিসেবে দেশের মানুষের জন্য বছরে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ষাট হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। বিটিএমএ সদস্যরা ৭ বিলিয়ন মিটার কাপড়ের প্রায় ৯০ শতাংশ সরবরাহ করছে। যা আমদানি পরিপূরক হিসেবে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছে।
তিনি আরো বলেন, টেক্সটাইল খাতে সমৃদ্ধ দেশগুলো এখনো তাদের ডিজাইন, ফ্যাশন ও টেকনোলজি নিজেদের হাতেই রেখে দিয়েছে। তাদের মধ্যে অনেক দেশেই তুলা উৎপাদন হয় না। তারা তুলা কিংবা সুতা আমদানি করে পোশাক খাতে সমৃদ্ধ। পেট্রোকেমিক্যাল রিফাইনিং আরো বিশ বছর আগে চিন্তা করার দরকার ছিল। টেক্সটাইল থেকে সরে আসার মতো সময় এখনো আমাদের দেশের হয়নি। আমরা যেদিন ইউরোপ, আমেরিকা ও ইটালির মতো অর্থনীতিতে শক্তিশালী হব, সেদিন আমাদের বলা লাগবে না। এমনিতে আমরা সরে যাব।
সরকারি সহায়তা আরো কত বছর লাগবে সাংবাদিকদের এ প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের থেকে গ্যাস বিল নেয়া হচ্ছে সাড়ে ৩১ টাকা আর পাওয়ার প্লান্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, তাদের থেকে নেয়া হচ্ছে সাড়ে ১৫ টাকা। এটা বৈষম্য। তার ঘাটতি আমাদের থেকে নেয়া হয়। এটা তো ভারতবর্ষে নেই। পল্লী বিদ্যুতের কমার্শিয়াল ইন্ডাস্ট্রির সারপ্লাসের ভর্তুকিও আমাদের থেকে নিয়ে পূরণ করা হয়। ভারতবর্ষে কখনো শিল্পের সঙ্গে সরকারের ভর্তুকি মেলানো হয় না। আমরা সাবসিডির বিকল্প চাই। গ্যাস ও বিদ্যুতের দরে বৈষম্য দূর করুন।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ধরে নিন তুলা নেই। আমরাও সুতা উৎপাদন করলাম না। কাপড়ও তৈরি হলো না। তাহলে এ ১৬ কোটি মানুষের পোশাক কোথায় থেকে আসবে। তাহলে কী আপনি বর্ডার খুলে দেবেন। চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য তৈরি করতে চান?
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশে প্রাইমারি টেক্সটাইল সেক্টর গত অর্থবছরে প্রায় ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন বেল তুলা আমদানি করেছে। এতে ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়েছে। আমদানির বিপরীতে ৪৭ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার প্রচ্ছন্ন রপ্তানি এবং ১২ বিলিয়ন ডলার দেশীয় বাজারে সরবরাহসহ মোট ৩৯ বিলিয়ন ডলার অবদান রাখছে।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর