করোনা মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে যখন দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে আসার চেষ্টা করছে ঠিক তখনই সারাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি আবার একই সময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। চলমান এ আন্দোলন দীর্ঘায়িত হলে সেশনজটের আশঙ্কায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এদিকে কোটা আন্দোলনকারীরা কঠোর আন্দোলনের দিকে গেলে এর প্রভাব স্কুলকলেজ ও চলমান এইচএসসি পরীক্ষার উপর পড়বে। ফলে দেশের শিক্ষা-ব্যবস্থায় চরম বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে শিক্ষকদের আন্দোলনে চলমান জিএসটি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। একইসাথে কৃষিগুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষাও এক ধরনের অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে শিক্ষাঙ্গনের চতুর্মুখী আন্দোলনে কোন পথে এগোবে দেশ?
অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারীকৃত পেনশনসংক্রান্ত বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, প্রতিশ্রুত সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবিতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সারাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কর্মবিরতি ও ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনে কার্যত স্থবির হয়ে রয়েছে দেশের সর্বোচ্চ এ শিক্ষাঙ্গণ। বছরের এ সময়টিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলে টার্ম ও সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। গুরুত্বপূর্ণ এ পরীক্ষা বন্ধ থাকায় সেশনজটের শঙ্খায় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। শিক্ষকদের এ আন্দোলনে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ছেড়েছে।
এছাড়া চলমান জিএসটি গুচ্ছ ভর্তি কার্যক্রমও বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষকরা। এদিকে দাবি মেনে না নিলে কৃষি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা না নেওয়ার ঘোষণা দেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। শিক্ষকদের আন্দোলন নিবৃত্ত করতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সাথে বৈঠক করার কথা থাকলেও রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ততার অজুহাতে বৈঠকটি স্থগিত হয়। সরকারের সংশ্লিষ্টের উচিত শিক্ষক নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে সমাধানের দিকে যাওয়া, না হয় পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ার চরম আশঙ্কা রয়েছে। দেশ যখন উন্নয়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে বিপর্যস্ত হবে দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের গবেষণা কার্যক্রমসহ পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা।
এদিকে সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা-২০২৩ এর প্রজ্ঞাপন হতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহার ও কর্মকর্তাদের জন্য ইউজিসির সুপারিশকৃত অভিন্ন নীতিমালায় ১২ দফা সংযোজনের দাবিতে বাংলাদেশ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বানে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা পূর্ণ দিবস কর্মবিরতির ফলে অফিস ও অ্যাকাডেমিক সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়েছে। এতে অচল অবস্থা বিরাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে।
এছাড়াও পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে বাংলাদেশ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী সমিতির ডাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরাও কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে। এক কথায় যদি বলি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শাটডাউন পরিস্থিতি চলছে।
২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে (৫৬ শতাংশ) কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর পর থেকে টানা সাড়ে পাঁচ বছর কোনো কোটা ছাড়াই নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগ হয়। ২০২১ সালে ওই পরিপত্রের ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল হওয়ার অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট করেন। ৫ জুন এই রিটের রায়ে পরিপত্রের ওই অংশ অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে শুরু হতে থাকে নানা আলোচনা-সমালোচনা এবং বিক্ষোভ ও আন্দোলন।
গত বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগের শুনানিতে হাইকোর্টের রায় স্থগিত হয়নি। আবেদনের শুনানি মুলতবি রাখা হয়েছে। এ রায়ের ফলে ফুঁসে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ। কোটা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। কোটা বাতিলের দাবিতে রাস্তা অবরোধ, বিক্ষোভ-মিছিল সহ নানা নানা কর্মসূচিতে মুখরিত ক্যাম্পাসসমূহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও কোটা সংস্কারের পক্ষে ফেসবুক ও সংবাদমাধ্যমে নিজেদের মতামত প্রকাশ করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে একমত পোষণ করেছেন। ছাত্র সমাজ সরকারকে তাদের এ আন্দোলন হালকাভাবে না নিতে বলেছেন। তাঁরা বলছেন, ছাত্রসমাজের এ গণজাগরণকে হালকাভাবে নিবেন না! হাওয়ার সাথে উল্টে যেতে পারেন! বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস ভুলে যাননি আশা করছি। পূর্বপুরুষদের রক্তে ভেজা জমিনে বৈষম্যের ঠাঁই হতে দেওয়া হবে না। ছাত্র-সমাবেশসূমহ জনসমুদ্রে রূপ নেবে।
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকার বাধ্য হয় কোটা সংস্কারের দাবি থেকে কোটা বাতিল করতে। সরকার কোটা বাতিল করলেও শিক্ষার্থীরা কোটা সম্পূর্ণ বাতিল চায়নি। তারা চেয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সহ মোট কোটার পরিমাণ ৫৬% থেকে ১০ % নামিয়ে আনা। কিন্তু তা না করে তখন ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডের সকল কোটা বাতিল করে দেয়। কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা এখনো সম্পূর্ণ কোটা বাতিল চায়না। তারা চায় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানার্থে কিছু নির্দিষ্ট কোটা, উপজাতি, প্রতিবন্ধী ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য মোটা ১০% কোটা রাখতে। গত আন্দোলনকে সামনে রেখে দেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ যদি আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনা করে সমাধান করে নেয় তবে সেটা হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। তবে গত আন্দোলনের পর্যালোচনা থেকে বলতে পারি, কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন যদি দীর্ঘায়িত হয় তবে দেশ একটি সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে এগোবে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কোটা আন্দোলনকারীদের সাথে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। এদিকে কোটা আন্দোলনকারীদের সাথে এক এক করে একাত্মতা পোষণ করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
শিক্ষার্থীরাও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের দাবির সাথে একমত পোষণ করতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও সংবাদমাধ্যমে। যদি শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এক হয়ে আন্দোলনের দিকে এগোয় তবে পরিস্থিতি চলে যেতে পারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এছাড়াও কোটা আন্দোলনের প্রভাব পড়া শুরু করেছে দেশের বিভিন্ন স্কুলকলেজ ও জেলা শহরগুলোতে। স্কুলকলেজের শিক্ষার্থীরাও কোটা বাতিলের দাবিতে মাঠে নেমে আন্দোলনের চিন্তা করছে। যদি আলোচনায় কোটা সমস্যার সমাধান না হয় তবে কোন পথে এগোবে দেশ? দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহকে বাঁচাতে, শিক্ষাঙ্গনের শাটডাউন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের এখনই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর
ক্যাম্পাস এর সর্বশেষ খবর