বরগুনার আমতলী উপজেলায় ১০০টি লোহার সেতু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখনো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সেতুগুলো ধসে আবার যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় জনসাধারণ।
গত ২২ জুন ২০২৪ উপজেলার হলদিয়া বাজার সংলগ্ন সেতু ধসে ৯ জনের প্রাণহানির ঘটনার পর আমতলী উপজেলা এলজিইডি বেশ নড়েচড়ে বসেছে। তারা ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর দুই পাশে সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড টানানো এবং সেতুর প্রবেশ মুখে বাঁশের বেড়া ও প্রতিবন্ধকতা খুঁটি স্থাপন করেছে।
আমতলী উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদপ্তর (এলজিইডি) সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৭-৯৮ থেকে শুরু করে ২০০৮-২০০৯ সাল পর্যন্ত এলজিইডির আওতায় আমতলী উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় ‘হালকা যান চলাচল প্রকল্পের’ অধীনে শতাধিক সেতু নির্মাণ করা হয়। প্রকল্পটি ২০০৮-২০০৯ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। এরপর প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি না করায় এসব সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ এবং মেরামতে আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে জনগুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জায়গায় গার্ডার সেতু নির্মাণ করে দিয়েছে স্থানীয় এলজিইডি।
লোহার সেতুগুলো নির্মাণের পর এসব সেতু রক্ষণাবেক্ষণের কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় এরই মধ্যে ২০০৭ সালের সিডরের রাতে কেওয়াবুনিয়া খালের, ২০১৫ সালের ৮জুন আঠারগাছিয়া ইউনিয়নের সোনাখালী মুসুল্লী বাড়ির খালের, ২০১৫ সালের ১৪ মে সোনাখালী স্কুল এন্ড কলেজের সামনের খালের, ২০১৬ সালের ১৬ মে রোয়ানুর রাতে বাঁশবুণিয়া খালের, একই বছর ৯ জুলাই আমড়াগাছিয়া খালের, ২০১৯ সালের ১০ মার্চ কুকুয়া ইউনিয়নের কুতুবপুর খালের, ২০২২ সালের ২৪ জুন কাউনিয়া খালের, ২০২২ সালের ১৫ মে দক্ষিণ পশ্চিম আমতলীর আরপাঙ্গাশিয়া খালের, ২০২২ সালের হলদিয়া ইউনিয়নের আলতাফ হোসেন মোল্লা বাড়ির খালের, ২০২৪ সালের ২৬ মে মধ্য চন্দ্রা খালের, সেতুসহ অন্তত ১৫টি সেতু অধিক জরাজীর্নতার কারণে ধসে পরে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২২ জুন শনিবার দুপুরে হলদিয়া বাজার সংলগ্ন সেতুটি মাইক্রোবাসসহ ধসে ৯ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
এর বাইরে এখন যে সেতুগুলো খালের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে সেগুলোও শত ভাগ জরাজীর্ণ হয়ে চলাচলের অনুপযোগী অবস্থায় রয়েছে। এরপর ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর ও ২০০৯ সালের আইলায়, ২০১১ সালের মহাসেন ও ২০১৬ সালের রোয়ানু এবং সর্বশেষ মালের প্রভাবে অধিকাংশ সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেতুগুলোর সিমেন্টের ¯পিলার, হাতল ও অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে। সেতুগুলো এভাবে পরে থাকায় এর হাতল ও অ্যাঙ্গেল বিভিন্ন মালামাল চুরি হয়ে যাচ্ছে। ধসে পরা সেতু এগুলোর স্থানে এলাকার বাসিন্দারা উদ্যোগ নিয়ে বাঁশ, তক্তা, সুপারিগাছসহ অন্যান্য গাছ দিয়ে কোনো রকম মেরামত করে ঝুঁকি নিয়ে এসব সেতু পারাপার হতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন পথচারী ও শিক্ষার্থীরা।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে,গত ২২জুন ২০২৪ খ্রী : শনিবার হলদিয়া বাজার সংলগ্ন লোহার সেতু ধসের পর এখন পুরো ইউনিয়ন উপজেলা সদরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। উপজেলা সদরসহ ঢাকা কিংবা বরিশাল যেতে হলে এই সেতু পারাপার হয়ে ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হাজার মানুষের চলাচল করতে হয়।
বর্তমানে ধসে যাওয়া সেতুর স্থানে চলাচল করার জন্য নারী সাংসদ প্রভাষক ফারজানা সুমির অনুদানের টাকায় বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করছে। বাঁশের সাঁকো দিয়ে নারী ও শিশু ও কোমলমতি শিক্ষার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছেন।
মজস্থানীয় ইউপি সদস্য রুহুল আমিন বলেন, ব্রিজ ভেঙে যাওয়ায় মোগো চাওড়া ও হলদিয়া ইউনিয়নের লোকজনের যাতায়াত হইয়া গ্যাছিল। মহিলা এমপি মোগো বাশের সাঁকো দিয়ে দিয়েছে এহন মোরা এই হাক্কা(সাঁকো) দিয়া চলাচল করি।
অপর দিকে হলদিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ তক্তাবুনিয়া গ্রামের বাশবুনিয়া খালের জেবি শেনের হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন সেতুটি ২০১৬ সালের ১৬ মে শনিবার বিকেলে রোয়ানুর প্রভাবে মুষল ধারে বৃষ্টির সময় কয়েক জন যাত্রী সহ সেতুটির মাঝ বরাবর ৩০ মিটার দৈর্ঘ্যের অংশ ধসে খালের পানিতে পরে যায়। এসময় সেতু দিয়ে পারাপার হওয়া যাত্রী দক্ষিণ তক্তাবুনিয়া গ্রামের আলতাফ, সেলিম. ওসমান. গনি সোহাগ মোল্লা নাসিম ফকির, সোহেল মোল্লা ও জাহিদুল মৃধা খালে পরে গুরুতর আহত হন। এসময় স্থানীয় লোকজন তাদের ডাক চিৎকার শুনে উদ্ধার করে আমতলী হাসপাতালে এনে চিকিৎসা করান। সেতুটি ধসে পড়ায় জগৎ চাঁদ, মধ্য টেপুরা, উত্তর টেপুরা, দক্ষিণ টেপুরা, পূর্ব টেপুরা ও দক্ষিণ তক্তাবুনিয়া গ্রামের প্রায় ১০ হাজার মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছে।
এছাড়া সেতুর পশ্চিম পাড়ে জেবি শেনের হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং দক্ষিণ তক্তাবুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছোট ছোট কোমল মতি শিশুদের পারাপারে মহা ভোগান্তি দেখা দিয়েছে। এলাকা বাসী নিরুপায় হয়ে তাদের চলাচল ঠিক রাখার জন্য বর্তমানে সেতুর জায়গায় একটি তিন তক্তার ডিঙ্গী নৌকায় খেয়া পারা পার হিসেবে চালু করেছেন গ্রামের সাধারণ জনগণ।
কুকুয়া ইউনিয়নের কেওয়াবুনিয়া খালের লোহার সেতুটি সিডরের সময় দুমড়ে মুচড়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও এখনও সংস্কার করা হয়নি। স্থানীয় শিক্ষক মোজাম্মেল হক জানান সেতুর এক প্রান্তে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়দের চলাচলের সুবিধার জন্য বাঁশের সাঁকো দিয়ে কয়েক হাজার মানুষ চলাচল করছে।
একই অবস্থা হলদিয়া ইউনিয়নের মোল্লাবাড়ি সংলগ্ন সেতুটি ধসে পড়ার পর স্থানীয়রা একটি বাঁশের সাঁকো তৈরি করে পারাপার হচ্ছে।
কাউনিয়া খালের সেতুটি ধসের পর সেখানে স্থানীয়রা চাঁদা তুলে প্লাস্টিকের ড্রাম এবং কাঠ দিয়ে একটি ভাসমান সেতু তৈরি করে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। এখানে প্রতিদিন শত শত শিক্ষার্থী কাউনিয়া ইব্রাহিম একাডেমি ও কাউনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে।
গত ২২ জুন শনিবার হলদিয়া ইউনিয়নের হলদিয়া বাজার সংলগ্ন সেতুটি ধসে ৯জনের প্রাণহানির পর আমতলী উপজেলা এলজিইডি নড়েচড়ে বসেছে। তারা ইতোমধ্যে উপজেলার ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর তালিকা তৈরি করে সেতুর প্রবেশ মুখে সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড এবং খুঁটি বসিয়েছে। তালিকা অনুযায়ী দেখা যায় হলদিয়া ইউনিয়নে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ সেতু রয়েছে ১৮টি, গুলিশাখালী ইউনিয়নে ২৫টি, আরপাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নে ৮টি, কুকুয়া ইউনিয়নে ৪টি, আমতলী সদর ইউনিয়নে ৮টি, আঠারগাছিয়া ইউনিয়নে ২১টি, চাওড়া ইউনিয়নে ১২টি এবং আমতলী পৌরসভায় ৪টিসহ মোট ১০০টি সেতু রয়েছে।
আমতলী উপজেলা এলজিইডি কার্যালয়ের প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ৯৯টি ঝুঁকিপূর্ণ লোহার সেতুর তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানো হয়েছে। এশকাল সেতুর প্রবেশ মুখে সতর্কী করন সাইনবোর্ডসহ ভারী যানবাহন চলাচলের প্রতিবন্ধকতার জন্য খুঁটি পুঁতে দেওয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ২০৯৭-২০৯৮ সালে গ্রামীণ সড়ক নেটওয়ার্ক সৃষ্টির জন্য এসব সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এই প্রকল্পটি বাতিল করায় ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলো মেরামত কিংবা সংস্কার করা যায়নি। তিনি আরো বলেন, যে সকল স্থানে লোহার সেতু রয়েছে তা অপসারণ করে গার্ডার সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছ।
বরগুনার এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মেহেদি হাসান খান বলেন,অধিক ঝুঁকিপূর্ণ সেতু চিহ্নিত করে সেগুলোর তালিকা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানো হয়েছে । আশা করি খুব শীঘ্রই গার্ডার অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজগুলোর স্থানে গার্ডাও ব্রিজের কাজ শুরু করা যাবে।
আমতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মাদ আশরাফুল আলম বলেন, ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর তালিকা করা হয়েছে। তার মধ্যে জনগুরুত্বপূর্ণ সেতুগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে যাতে নির্মাণ করতে পারি তার জন্য সুপারিশ করে পাঠানো হয়েছে।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর