দেওয়ানগঞ্জ সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তরে গারো পাহাড়ের পাদদেশে ডাংধরা ইউনিয়নের কউনিয়ারচর বাজার। সাত মাস আগে এ বাজারে শাখা অফিস স্থাপন করে ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এন্টারপ্রাইজ(আইডিই) নামে একটি এনজিও।
শুরু থেকেই এনজিওটি সমাজের অবহেলিত পিছিয়ে পড়া হতদরিদ্র মানুষকে আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে টিনশেড ও থ্রিকোয়ার্টার ঘর ও পুষ্টি প্রকল্পের মাধ্যমে শিশু ভাতা দেওয়ার কথা বলে ডাংধরা ও চরআমখাওয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের মানুষকে সদস্য করে তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করে অর্থ। গ্রাহকদের অভিযোগ, প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সহায়তা না দিয়ে প্রায় তিন হাজার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রায় তিন কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়েছে এনজিওটি। এতে দিশেহারা হয়ে পরেছেন এ অঞ্চলের প্রায় তিন হাজার সাধারণ মানুষ। অর্থ ফিরে পাওয়াসহ এনজিওটির কর্তৃপক্ষের প্রতারণার শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এন্টারপ্রাইজ(আইডিই) নামে এনজিওটির দেওয়ানগঞ্জ শাখাটির ব্যবস্থাপক হিসেবে কুড়িগ্রাম জেলার রাজিবপুর উপজেলার মো. রনি আহমেদ, অডিট অফিসার হিসেবে কামরুজ্জামান বন্ধন এবং ফিল্ড অফিসার হিসেবে রেজাউল করিম রেজা দায়িত্ব পালন করেন। তারা শুরুর দিকে স্থানীয়ভাবে ১৩ জন কর্মী নিয়োগ দিয়ে কার্যক্রম শুরু করেন। প্রথম পর্যায়ে শর্ত সাপেক্ষে সাত থেকে আট হাজার টাকা তাদের বেতন নির্ধারণ করে নামে মাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে মাঠে নামিয়ে দেন এনজিওটির কর্তৃপক্ষ।
নিয়োগকৃত কর্মীদের মাধ্যমে প্রথম ধাপে ডাংধরা ও চরআমখাওয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের ৩০০ দরিদ্র পরিবারের মাঝে প্রথম ধাপে বিনামূল্যে কম্বল, ময়দা, তেল বিতরণ করেন। দ্বিতীয় ধাপে ১৫০ সদস্যের মাঝে টিনশেড ঘর দেওয়ার কথা বলে সদস্য প্রতি ২৫ হাজার করে টাকা নেয়। তৃতীয় ধাপে ২ হাজার ৫০০ সদস্যকে ১৮ হাজার ৭২০টাকা পুষ্টি ভাতা দেওয়ার কথা বলে সদস্য প্রতি ২ হাজার ৫০০ করে নেয়। চতুর্থ ধাপে ২৪০ জন সদস্যকে থ্রি কোয়ার ঘর দেওয়ার কথা বলে সদস্য প্রতি ৪০ হাজার টাকা করে নেয়। পঞ্চম ধাপে ১০০ জন সদস্যকে টিউবওয়েল ও পাকা স্যানিটারি ল্যাট্রিন দেওয়ার কথা বলে সদস্য প্রতি ২০ হাজার টাকা করে নেয়। খসড়া হিসাবে পাঁচটি ধাপে সর্বমোট ২ কোটি ১৬ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় এনজিওটি।
এক সময় প্রতিশ্রুতি সহায়তা দিতে গড়িমসি বা সময় ক্ষেপন করলে সদস্যদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে। বিষয়টি টের পেয়ে এনজিওটির কর্তৃপক্ষ ফেরত না দিয়ে গ্রাহকদের প্রায় তিন কোটি টাকা নিয়ে হঠাৎ লাপাত্তা হয়ে যায়। পরে এ ব্যাপারে ওই এনজিওর মাঠকর্মী হারুনুর রশীদ বাদি হয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। কয়েকজন মাঠকর্মী জানান, প্রাথমিক ভাবে মানুষের মাঝে বিশ্বাস আনতে বখতিয়ার ভক্ত মেম্বারসহ কয়েক জন সদস্যদের ঘর দেন।
একটি সূত্র জানায়, ওই এনজিওর বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করেন স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. বখতিয়ার হোসেন ভক্ত।
পাথরের চরের শফিকুল ইসলাম শফি বলেন, আমি গরিব মানুষ। সরকারি জমিতে ঘর উঠিয়ে দিনযাপন করছি। ঘর দেওয়ার কথা শুনে প্রথমে বিশ্বাস করিনি। পরে তাদের কাছে স্থানীয় ডাংধরা ইউপি চেয়ারম্যানের সীলসমেত স্বাক্ষর দেখে বিশ্বাস করি। অনেক কষ্ট করে ছাগল বিক্রি করে ১৫ হাত টিনশেড ঘরের জন্য ২৫ হাজার টাকা দিই। তাতে আমাকে শুধু ঘরের চাল দেওয়া হয়। সেটা দেখে আমার আশেপাশের বেশ কয়েক জন ঘরের জন্য টাকা দেন। হঠাৎ একদিন জানতে পারি এনজিওটির লোকজন পালিয়ে গেছে।
সানন্দবাড়ী সবুজপাড়া গ্রামের কতিরন বেগম জানান, ওই এনজিওর লোক প্রথম দিন বাড়িতে এসে নাম লিস্ট করে গেছেন। তারপর একদিন ঘর দেওয়ার কথা বলেন। সে সময় ৪০ হাজার টাকা চাইলে আমি বিপাকে পড়ে যাই। আমি গরীব মানুষ। ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার ঘরের আশায় চেয়ে টিমটে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছি। এখন শুনছি তারা পালিয়ে গেছে। আমার মতো অনেকের কাছ থেকে তারা টাকা নিয়েছে। আমরা আমাদের টাকা চাই।
পাথরেরচর গুচ্ছ গ্রামের সাবিনা পারভীন বলেন, আমি অভাবী মানুষ। আমাদের পার্শ্ববর্তী এক সদস্যকে ঘরের চাল দিয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করে অন্যের কাছে সুদে টাকা নিয়ে ২৫ হাত থ্রি কোয়ার্টার ঘরের জন্য ঈদের আগে ৪৫ হাজার টাকা দিয়েছি। আমাকে কিছুই দেওয়া হয়নি। এখন শুনছি ওই এনজিওর লোকজন অফিসে তালা দিয়ে পালিয়ে গেছে। আমার সাথে এ গ্রামের বেশ কয়েকজন ঘরের জন্য টাকা দিয়েছে। কেউ কেউ শিশু ভাতার জন্য টাকা দিয়েছে।
ওই এনজিওর মাঠকর্মী হারুনুর রশিদের ভাষ্য, ওই এনজিওর কর্মকর্তাদের মধ্যে একজনকে চিনতাম। তাদের সবাইকে অন্ধ বিশ্বাস করতাম। আমরা ঘর ও শিশু ভাতা দেওয়ার কথা বলে সদস্যদের কাছ থেকে টাকা এনে অফিসে জমা দিতাম। ১৩ জন মাঠ কর্মীর মধ্যে ১২ জন ছিলেন মহিলা। কেবল আমিই ছিলাম পুরুষ। আমাদের মাধ্যমে প্রায় তিন হাজারের মতো সদস্যদের কাছ থেকে প্রায় তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে এনজিওটি।
ডাংধরা ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান বলেন, ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এন্টারপ্রাইজ(আইডিই) নামে এনজিওটি যখন অফিস করে তখন আমাকে জানায়নি। পরে জানতে পেরে আমি তাদেরকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে ইউএনও স্যারের সাথে সাক্ষাৎ করার কথা বলে পাঠিয়েছিলাম। এরপর কি হয়েছে আমাকে তারা জানায়নি। এরপর বিভিন্ন ব্যস্ততায় জড়িয়ে পরায় কোনো খোঁজ খবর নিতে পারিনি। এখন শুনছি তারা পালিয়ে গেছে। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে এনজিওটির কর্তৃপক্ষকে ফোন করা হলে তাদের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
মডেল থানার ওসি বিপ্লব কুমার বিশ্বাস জানান, এ ব্যাপারে আমার কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ জাহিদ হাসান প্রিন্স জানান, ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এন্টারপ্রাইজ (আইডিই) নামে এনজিওটির নামে আমার কাছে অভিযোগ এসেছে। তারদের সাথে ফোনে কথাও হয়েছে। কিন্তু তারা বিষয়টি সমাধান করতে আসেননি। এ ব্যাপারে ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর