
ফরিদপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের সামনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা করেছে ছাত্রলীগ। এ হামলায় ৬ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) বেলা ১১টার দিকে ফরিদপুর শহরের ঝিলটলি মহল্লার ব্রাহ্মসমাজ সড়কে ফরিদপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
আহতরা হলেন- সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের মার্কেটিং বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আবরাব নাদিম (২৬) ও গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিক অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (ইইই) চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী কাজী নিশাত (২৫)। বাকিরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে ব্রাহ্মসমাজ সড়কের সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে জড়ো হয় কোটাসংস্কার আন্দোলনের ছাত্র-ছাত্রীরা। এ সময় সেখানে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হাসানুজ্জামানের নেতৃত্বে প্রায় ২৫ জনের বেশি পুলিশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটের দিকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের নিরাপত্তা এবং শহরের মানুষের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ ব্রাহ্মসমাজ সড়কে আন্দোলনকারীদের অবরোধের জন্য নির্বাচন করে দেন ওসি হাসানুজ্জামান।
এ সময় আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে ওসি বলেন, এই সড়ক ছেড়ে আপনারা অন্য কোথাও গেলে শহরের মানুষের ভোগান্তি হবে এবং আপনাদের নিরাপত্তাও লঙ্ঘিত হতে পারে। তাই সার্বিক বিবেচনায় আপনারা দাবি আদায়ের আন্দোলন এই সড়কেই করবেন। ওসির এই বক্তব্য মেনে নিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন ফরিদপুরের প্রধান সমন্বয়কারী সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শাহ মোহাম্মদ আরাফাত সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন।
এরপর বেলা ১১টার এক মিনিট আগে পুলিশের বাছাই করে দেওয়া ব্রাহ্মসমাজ সড়কের সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে সড়ক অবরোধ করে বসেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় তারা ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘ছাত্র সমাজের অ্যাকশন ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘ঢাবিতে হামলা কেন, চবিতে হামলা কেন প্রশাসন জবাব চাই’ বলে স্লোগান দেন।
ব্রাহ্মসমাজ সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকায় পুলিশ সবাইকে ফিরিয়ে অন্য রাস্তা ব্যবহার করতে পরামর্শ দেয়। ব্রাহ্মসমাজ সড়কটি শহরের আলাউদ্দিন কমিউনিটি সেন্টার থেকে ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালের মোড় পর্যন্ত আনুমানিক ৩০০ মিটারের একটি সড়ক। এই সড়কটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেউ চাইলেই এই সড়ক এড়িয়ে আশপাশের সড়ক দিয়ে শহরের যেকোনো জায়গায় যাতায়াত করতে পারেন।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ফরিদপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে যখন কোটা সংস্কারের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিলেন আন্দোলনকারীরা তখন অপরদিক শহরের আলাউদ্দিন কমিউনিটি সেন্টারের দিক থেকে ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অমিত বিশ্বাসের নেতৃত্বে অন্তত ২৫-৩০টি মোটরসাইকেলে ৫০ থেকে ৫৫ জন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে ঘটনাস্থলে ঢোকার চেষ্টা করেন। ব্রহ্মসমাজ সড়কের ইউনিকেয়ার প্রাইভেট হাসপাতালের সামনে এলে তাদের মোটরসাইকেলের গতিরোধ করেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। এ সময় ফরিদপুর কোতোয়ালি থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসানুজ্জামান আনুমানিক ৫০ মিটার দূরে সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিলেন। পুলিশ সদস্যদের পাশ কাটিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দৌড়ে এসে আন্দোলনকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছাত্রলীগের দু একজনের মুখে কালো কাপড় এবং কয়েকজনের মাথায় হেলমেট ও হাতে লাঠিসোঁটা ছিল। তারা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের লাঠি দিয়ে আঘাত করে। তবে ঘটনা এড়াতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশদের এ ব্যাপারে তেমন কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। ছাত্রলীগের হামলায় ঘটনাস্থল থেকে আন্দোলনকারীরা দৌড়ে ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালের দিকে চলে গেলে এবং আহতদের নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে যেতে থাকে। এরপর মোটরসাইকেলে করেই যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকেই চলে যায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। হামলার ঘটনা ঘটার কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থলে আসেন ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শৈলেন চাকমা (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোহাম্মাদ সালাউদ্দিন।
ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের মার্কেটিং বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আবরাব নাদিম বলেন, ওসি সাহেব আমাদের বলেছিলেন আপনারা এই সড়কে আন্দোলন করেন আপনাদের নিরাপত্তা আমরা দেব। তিনি কথা রাখেননি। তার সামনে তার পুলিশ সদস্যদের নির্লিপ্ততায় আমাদের ওপর বর্বরোচিত হামলা হয়েছে। হামলাকারীরা অন্তত ৫ থেকে ৬ জন আমাকে যখন উপর্যুপরি ঘুসি মারছিলেন তখন আমার পাশে অনেক পুলিশ সদস্যরা দাঁড়িয়ে ছিল। আমি চিৎকার করে বলছিলাম ‘ভাই আমাকে বাঁচান।’ পুলিশ আমাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেনি।
তিনি বলেন, হামলাকারীরা ছাত্রলীগের। তারা আমাদের ভাই ব্রাদার। তাদের সবাইকে আমি চিনি, তারাও আমাকে চেনে। তবুও তারা হামলার সময় আমাকে বলছিল ‘এই শুয়োরের বাচ্চাকে আগে ধর।’ মারপিট করে আমার গায়ের পোশাক ছিড়ে নিয়ে গেছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কেটে ছিঁড়ে ফেলেছে।
ফরিদপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শাহ মোহাম্মদ আরাফাত বলেন, ছাত্রলীগও ছাত্র। আমাদের আশা ছিল তারাও আমাদের যৌক্তিক দাবিতে সমর্থন দেবে। তা না করে তারা আমাদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছে।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তামজিদুল রশিদ চৌধুরীর মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি রিসিভ না করায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
ফরিদপুর কোতোয়ালি থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দেননি। তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে নতুন করে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দ্বায়িত্বরত কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে আহত হয়ে দুইজন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এদের মধ্যে কাজী নিশাতের মাথার বিভিন্ন অংশে ফেটে গেছে। তার মাথায় সেলাই দেওয়া হয়েছে এবং আবরাবের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কিল ঘুসিতে ফুলে গেছে ও কেটে গেছে। তাদের দুজনকেই হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
বাঁধন/সিইচা/সাএ
সর্বশেষ খবর