
“বিচার পাইছি, বাড়িঘর পাইছি ও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাইছি। অহন আমরা ভালোই আছি। আর কত দিন বাঁচমু। মইরা গেলেও আর কোন দুশ্চিন্তা থাকবো না। স্বামী স্বজনদের কথা মনে অইলে খুব কষ্ট লাগে। বর্তমান সরকার রাজাকার ও আলবদরদের বিচার কইরা আমগর হেই কষ্ট দুর কইরা দিছে।”
কথাগুলো বলছিলেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত সোহাগপুর বিধবাপল্লীর বীরাঙ্গনা হাফিজা বেওয়া (৭০)।
একই গ্রামের অপর বীরাঙ্গনা মহিরন বেওয়া (৭২) কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, সরকার আমগরে থাহুনের লাইগা বাড়িঘর বানাইয়া দিছে। নির্যাতনের শিকার অওনে নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিছে। আমগর স্বামী সন্তানগরে মারনের বিচার করছে। অহন আমরা শান্তি লইয়া মরবার পামু। এভাবেই ১৯৭১ সালে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে স্বামী সন্তান হারানোর দীর্ঘ সময় পর সরকারিভাবে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পেয়ে মনের আকুতি প্রকাশ করেন তারা।
আজ ২৫ জুলাই সোহাগপুর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে নালিতাবাড়ী উপজেলার কাঁকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও দেশীয় রাজাকার আলবদররা সেদিনের পৈশাচিক হত্যাকান্ড চালিয়ে এই গ্রামের ১৮৭ জন নিরীহ পুরুষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তখন বিধবা হন এই গ্রামের ৬২ জন নারী। সোহাগপুর বেনুপাড়া গ্রামের সব পুরুষ মানুষকে মেরে ফেলার কারনে স্বাধীনতার পরে এই গ্রামের নাম বদলে দিয়ে নতুন নাম রাখা হয় সোহাগপুর বিধবাপল্লী।
জানা গেছে, ১৯৭১ সালের মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়েতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ৭টি অভিযোগের মধ্যে তৃতীয় অভিযোগটি ছিল সোহাগপুর গ্রামের হত্যাযজ্ঞ ও ধর্ষণ। এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ তাকে মৃত্যুদন্ড দেন। বর্তমানে সরকারিভাবে সোহাগপুর গ্রামের ২৯ জন বিধবা নারীকে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রানালয়ের মাধ্যমে বাড়িঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।
ইতোমধ্যে এই গ্রামের বেশ কয়েক জন বিধবা নারী দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। স্বজন হারানোর দুঃখ বেদনার ক্ষত আর সেদিনের বিভীষিকা নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে আজো বেঁচে আছেন ২১ জন বিধবা নারী। নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীর মধ্যে প্রথমে ১৪ জন ও পরে ৬ জনসহ মোট ২০ জন নারীকে নারী মুক্তিযোদ্ধা তথা বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বেঁচে থাকা বিধবারা প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা করে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন। ট্রাস্ট ব্যাংকের মাধ্যমে ২ হাজার টাকা, বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক থেকে ৫শ টাকা ও সরকারিভাবে আরো বিধবাভাতা হিসেবে ৫শ করে টাকা পান। বিধবা নারী ও স্বাজনরা সরকারের প্রতি সন্তষ্টি প্রকাশ করলেও সেই দিনের পৈশাচিক নারকীয় হত্যাকান্ডের কথা আজও তারা ভুলতে পারেননি।
সোহাগপুর বেনুপাড়া গ্রামের আলাল উদ্দিন (৭৩) বলেন, ‘গরম বালুর মধ্যে যেমনে মানুষ মুড়ি ভাজে। ঠিক তেমন করে পাকবাহিনীরা এই গ্রামে ঢুইকা গুলি ফুটাইছে। ১৮৭ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। সেই দিনের স্মৃতির কথা মনে হলে আজো শরীল শিউরে উঠে।’
নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুদ রানা বলেন, সোহাগপুর গণহত্যা দিবস পালন উপলক্ষে নানা কর্মসুচী গ্রহন করা হয়েছে। এসব কর্মসুচীর মধ্যে রয়েছে শহীদদের স্মরণে আলোচনা সভা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল।
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর