
চার মাসের ছোট্ট তামান্না জানেনা তার বাবা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। পরম যত্নে কোলে নিয়ে তাকে কখনো আর আদর করবে না বাবা। চির নিদ্রায় পুকুর পাড়ে শুয়ে আছে তামান্নার বাবা টিটু। তামান্নার মতই নিষ্পাপ তার ১০ বছরের বোন তানজিলা ও ৭ বছরের ভাই সাইমুন। তানজিলা ও সাইমুন কিছু বুঝতে পারে বাবার সঙ্গে আর কখনোই দেখা হবে না। কিন্তু ওদের অবুঝ মন মানতে চায়না কিছুতেই। বাবাকে খুঁজতে থাকে সারাক্ষণ।
এদিকে স্বামী হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন এই তিন সন্তানের মা আয়েশা বেগম। একদিকে স্বামী হারানোর শোক। অন্যদিকে দারিদ্র্য তাকে আঁকড়ে ধরেছে। ঘরে নেই চাল ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। সন্তানদের তিন বেলার খাবার জোগাড় করতেই এখন কষ্ট হচ্ছে তার। আর্থিক সংকট আর সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দিশেহারা মা আয়েশা বেগম। অসহায় আয়শা বেগম যাচ্ছেন প্রধান মন্ত্রীর সহায়তা।
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই ধানমন্ডিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মো. টিটু হাওলাদার (৩৫)। তিনি বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনবাদ ইউনিয়নের দক্ষিণ হোসনাবাদ গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রহিম হাওলাদারের ছেলে। ঢাকায় গ্রিন লাইফ হাসপাতালের এক চিকিৎসকের ব্যক্তিগত গাড়ির চালক ছিলেন টিটু।
আয়েশা বেগম জানান, তার স্বামী টিটু হাওলাদার সর্বশেষ ১১ জুলাই বাড়ি থেকে কর্মস্থল ঢাকায় যান। এর ৮ দিন পর ঢাকা থেকে খবর আসে তার স্বামী গুলিবিদ্ধ হয়ে ধানমন্ডির গ্রিন লাইফ হাসপাতালের চিকিৎসাধীন রয়েছে। গুলিতে তার মাথার মগজ বের হয়ে গেছে।
টিটুর স্ত্রী কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন ‘আমার স্বামী একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ছিলেন। সে তো কোন আন্দোলন করেনি। তার পরেও বিনা অপরাধে তাকে জীবন দিতে হলো। ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে বাবা বাবা বলে দিনরাত কান্নাকাটি করছে। ওদের কান্না কিছুতেই থামাতে পারছি না। শুধু বাবাকেই খুঁজছে। আমি এই অবুঝ সন্তানদের কী বুঝ দেব। সন্তানদের খাওয়ার মত আমার ঘরে কিছু নেই। এ কদিন মানুষে খাবার দিয়েছে। কতদিন মানুষ খাবার দিবে। তিনটি সন্তান নিয়ে আমি পরের বাড়িতে কাজও করতে পারছি না। কে আমাদের দেখবে। আমি কার কাছে আশ্রয় পাব। আয়শা বলেন, ‘উনি ঢাকায় যাওয়ার সময়ও ঘরে কোনো টাকা রেখে যেতে পারেনি। অভাব অনটনেই চলতো আমাদের সংসার। এরমধ্যে মানুষটা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল। আমি এখন কীভাবে সন্তানদের বড় করব, আর কী ভাবে খাবার জোগাড় করব।
আয়েশা বেগমের বড় মেয়ে তানজিলা বাড়ির কাছেই আনোর জলিশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। ছেলে সাইমুন স্থানীয় বয়াতি বাড়ি কওমি মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণির ছাত্র।
মৃত্যুর দুইদিন পর ২১ জুলাই রাতে টিটু হাওলাদারের ফুফাতো ভাই মো. রাকিব লাশ নিয়ে তার গ্রামের বাড়িতে আসেন। সেদিন রাতেই জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে টিটুকে দাফন করা হয়েছে।
লাশ বহনকারী রাকিব বলেন, টিটু ভাইর লাশ আনার মত টাকা আমার কাছে ছিল না। ঢাকা থেকে লাশ বাড়িতে আনতে ৪৭ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে আমি ২৭ হাজার টাকা দিয়েছি। টিটু ভাইর শ্যালক হাসান ২০ হাজার টাকা দিয়েছে। সরকারের উচিত ছিল পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো। মাননীয় প্রধান মন্ত্রী টিটু ভাইর পরিবারের পাশে থাকলে পরিবারটি খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারবে।
টিটুর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সন্তানের কবরের পাশে বসে বৃদ্ধ বাবা আব্দুর রহিম হাওলাদার কাঁদছেন। তিনি বলেন, এবারে আমার ছেলে ঢাকায় যাওয়ার সময় বলেছিল, বাবা ওদের দেখে রেখবেন। এখন আমার সারাজীবন রিকশা চালিয়ে পরিবার দেখতে হবে। এই ছিল আমার কপালে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. মাসুদ জানান, টিটু হাওলাদারের রিকশা চালক বাবা আব্দুর রহিম হাওলাদার এখন বয়সের ভারে তেমন রোজগার করতে পারেন না। টিটুর আরেক ভাই ইমরান হোসেনও রিকশা চালিয়ে সংসার চালায়। ছোট বোন ফাতিমা আক্তার (১৮) প্রতিবন্ধী হওয়ায় তাদের সঙ্গেই থাকেন। অন্য বোন রুমেনা বেগম (৩৫) থাকেন স্বামীর সংসারে।
বেতাগী উপজেলার নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান মো. খলিলুর রহমান খান বলেন, আমি ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম। পরিবারটি খুবই অসহায় হয়ে পড়েছে। আমার সাধ্যমতো তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করব। তবে সরকারি ভাবে যদি পরিবারটির দায়িত্ব নেওয়া হয়, তা হলে টিটুর স্ত্রীর ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে বেঁচে থাকার একটা উপায় হবে।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর