
‘৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর নেত্রকোনার বিভিন্ন মন্দির বিশেষ করে জেলা শহরের রামকৃষ্ণ মিশন ও ইসকন মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের খবর প্রচারিত হয় ভারতীয় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে। এছাড়া দেশীয় কিছু মাধ্যমেও এমন খবর প্রচার হতে থাকে। এসব খবর দেখে আমরা রীতিমতো অবাক হয়েছি। আমাদের মন্দিরে হামলা হলো অথচ আমরা জানলাম না, জেনে গেল ভারতীয় টিভি চ্যানেল।’
বৃহস্পতিবার বিকেলে নেত্রকোণা শহরের সাতপাই এলাকায় থাকা ইসকন মন্দিরে (শ্রী শ্রী জগন্নাথ বল্লভ মন্দির) গেলে এসব কথা বলছিলেন মন্দিরের ভেতরে অবস্থান রত প্রমীলা সরকার।
প্রমীলা সরকার বলেন, এই ইসকন মন্দিরের সাথেই আমার বাসা। নিয়মিত মন্দিরে আসি। এখানে হামলা বা ভাঙচুরের কোন ঘটনাই ঘটেনি। আপনিও ঘুরে দেখুন সবকিছু স্বাভাবিক। তবে ভারতীয় রিপাবলিক বাংলা নামের টিভিতে আমাদের মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের খবর দেখে অবাক হয়েছি। আমাকে ফোন দিয়েছে আত্মীয় স্বজনরা। আমাদের মন্দির আমরা জানলাম না হামলার বিষয়ে কিছু অথচ তারা জেনে গেল। আরও বেশ কিছু মাধ্যমেও এসব মিথ্যা সংবাদ প্রচার হয়েছে, এসব কাম্য নয়। এই শহরে হিন্দু-মুসলিম আমরা সবাই মিলে মিশে থাকি যুগ যুগ ধরেই। একে অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়াই।
মন্দিরের বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা চৈতন্য দাস ও বিদুর দাস বলেন, আমাদের মন্দিরে কোন হামলা বা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি। কেউ যদি এমনটা প্রচার করে থাকে সেটা মিথ্যা।
ইসকন মন্দির পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে দেখা যায় পরিচালনা কমিটির সদস্য মুক্তা সরকারকে। তিনি বলেন, মন্দিরে কেউ হামলা করেনি। সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে।
এদিকে একই সড়কে থাকা শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রমে গিয়ে জানা যায় সেখানেও কোন হামলা বা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি।
শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক উজ্জ্বল সরকার জানান, মন্দিরে কোন হামলা বা ভাঙচুর কিছুই হয়নি। সম্পূর্ণ নিরাপদ রয়েছে মন্দির। ৫ আগস্ট আমাদের মন্দিরের গেটের সোজা সড়কের বিপরীতে থাকা একজনের (সাবেক ছাত্রলীগ নেতা) ব্যক্তিগত চেম্বার ভাঙচুর হয়েছে। অনেকে হয়ত ভুল করে ভেবেছে যে ওইদিন আমাদের মন্দির ভাঙচুর হয়েছে।
মন্দির পরিচালনা কমিটির সদস্য পরিমল চন্দ্র দত্ত বলেন, আমরাও দেখেছি দেশী- বিদেশি বিভিন্ন মিডিয়ায় বলছে যে আমাদের মন্দিরের হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে। এসব দেখে তো আমরাও হতবাক হয়েছি। পরে ফেসবুক পোস্ট করে এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছি। কোন ধরনের হামলা হয়নি বলে জানিয়েছি। যেন কেউ এ বিষয়ে ভুল না বোঝে। মন্দিরের গেটের বিপরীতে একজনের ব্যক্তিগত চেম্বার ভেঙেছে সেটাকে হয়ত অনেকে মন্দির ভাঙা বলে চালিয়ে দিয়েছে। কমিটির অপর সদস্য রঞ্জণ সাহা বলেন একই কথা।
মন্দিরের পাশের বাসার স্বর্ণালী ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের মন্দিরে হামলা ভাঙচুরের খবর দেখে অবাক হলাম। বাইরে থেকে সবাই ফোন দিলো। আমাদের বাসা মন্দিরের সাথেই। মন্দিরের গেটের সামনে রাস্তার বিপরীতে ছাত্রলীগের সাবেক সহ সভাপতি মৃণাল কান্তি ভট্টাচার্যের একটি চেম্বার ছিলো দোকানসহ। ওইটাতে ওইদিন কারা যেন ভাঙচুর করেছে শুনেছি। ওইটার সাথে মন্দিরের কি সম্পর্ক বুঝলামনা। কারা এমন খবর দিলো তাও অজানা। ওইদিন চেম্বার ভাঙচুর করলেও আমাদের মন্দিরের দিকে কেউ চোখ তুলেও থাকায়নি। এখানে আমরা হিন্দু-মুসলিম সবাই মিলেমিশে বসবাস করি।
এ বিষয়ে জেলার হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি এড.শীতাংশু বিকাশ আচার্যের মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
জেলা পূজা উদ্যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক লিটন পণ্ডিত বলেন, আমাদের জেলায় কোন মন্দির বা উপাসনালয়ে হামলা-ভাঙচুর কিছুই হয়নি। কোথাও এমনটা শুনিনি।
উল্লেখ্য- ৫ আগস্ট জেলা জুড়ে শতাধিক দোকান ও বাড়ি ভাঙচুর লুটপাট ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। তার অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বাড়ি ও দোকানপাট। এদিন সাতপাই মন্দিরের সড়কে থাকা সাবেক ছাত্রলীগের নেতা অপু সরকার ও ছাত্রলীগ নেতা মৃণাল কান্তি ভট্টাচার্যের চেম্বার ভাঙচুর করা হয়। তবে মন্দিরে কোন হামলা হয়নি। নেত্রকোনার পূর্বধলায় হিন্দুদের মন্দিরে নাশকতা সৃস্টি করতে গিয়ে নেপাল চন্দ্র ঘোষ (৩৪) নামে সনাতন ধর্মের এক ব্যক্তিকে আটক করেছে স্থানীয় জনতা ও আনসার সদস্যরা।
উপজেলার জারিয়া ইউনিয়নের বাড়হা কালীবাড়ী মন্দিরে শনিবার দিনগত রাত ২ টার দিকে এমন ঘটনা ঘটে। আটককৃত নেপাল চন্দ্র ঘোষ মন্দিরের পাশেই বাড়হা ঘোষপাড়া গ্রামের সুধীর চন্দ্র ঘোষের পুত্র। পরে ১৮ আগস্ট রবিবার সকালে তাকে পুলিশের হাতে তোলে দেওয়া হয়। জনতার ধাওয়ার সময় নেপালের বাকী সংঙ্গীরা পালিয়ে যায়।
আটককৃত নেপাল চন্দ্র ঘোষ জানায় যে, মন্দিরে দান বাক্স ভেঙ্গে অর্থ লুট ও পরে আগুন দেওয়ার জন্য তার বাড়ির পাশে আর একজন সনাতন ধর্মের ব্যক্তি কৃষ্ণ ঘোষের পুত্র জয় চন্দ্র ঘোষ এবং পার্শ্ববর্তী দুর্গাপুর উপজেলার থেকে আরও ৬জনকে নিয়ে পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সবাই মিলে তারা হাতুরী-ছেনা দিয়ে দান বাক্স ভাঙার জন্য আঘাত করতে থাকে এবং শেষে আগুন দেওয়ার জন্য কিছু খড় ও গ্যাস ম্যাচ প্রস্তুত রাখে। হাতুরীর আঘাতের শব্দে স্থানীয় লোকজন টের পেয়ে ছুটে আসলে তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
নেত্রকোণা জামাতে ইসলামির আমির জনাব, অধ্যাপক সাদেক আহম্মদ হারিছ বলেন, আমরা বাংলাদেশ জামাত ইসলামের আমির এর নির্দেশনায় প্রত্যেকটি জেলা উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের মন্দির পাহারা দিচ্ছে, হিন্দু সম্প্রদায়িকি আতঙ্কে না থাকার জন্য আমরা সাহস যুগিয়ে আসছি।আওয়ামী লীগের কিছু সংখ্যক নেতার উসকানিতে ও তাদের সহযোগিতায় প্রলুব্ধ হয়ে বর্তমানের ছাত্র আন্দোলন কে নিঃসরাত করার লক্ষ্যে আ,লীগের দুষ্কৃতিকারীরা মন্দিরে এমন দুষ্কৃতকারী কার্যক্রম পরিচালনা করে বিধি সৃষ্টি করার জন্য এই কাজগুলো করছে। বাংলাদেশ জামাতে ইসলাম এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছে।
পূর্বধলা থানার অফিসার ইনচার্জ মো. তাজুল ইসলাম জানান, এ ঘটনার সাথে জড়িত নেপালকে আটক করে থানায় আনা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আইনি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর