
সন্তান আর কোন দিন ফিরে আসবে না জেনেও মানসিক ভারসাম্যহীন মা মেরিনা বেগম আজও ফ্যাল ফ্যাল করে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন কখন আসবে বুকের ধন একমাত্র সন্তান মিনহাজ (১৭)। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে ২০ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে গাজীপুরের বড়বাড়ি জয়বাংলা সড়কে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় একমাত্র সন্তান গার্মেন্টস কর্মী মিনহাজ।
অসুস্থ মা-কে সুস্থ করার স্বপ্ন নিয়ে কিশোর বয়সে গার্মেন্টসে চাকরি নেন মিনহাজ। ওভার টাইম সহ মাসে আয় করতেন ১৪-১৫ হাজার টাকা। থাকতেন গাজীপুরে খালু শাহ পরানের ভাড়ার ৫ তলা বাসায়। শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলন চলাকালে গত ২০ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে গাজীপুরের বড়বাড়ি জয়বাংলা সড়কে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর স্থানীয়রা তাকে জয়দেবপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। গাজীপুরের বাসায় যখন মিনহাজের মরদেহ নেওয়া হয় তখন তার মা মেরিনা বেগম শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। চোখ দুটো দিয়ে একমাত্র বুকের ধন সন্তানকে খুঁজলেও অসুস্থতার কারণে ছেলে হারানোর কষ্টও প্রকাশ করতে পারেনি মেরিনা বেগম।
মিনহাজের বাড়ি জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলার সোনামুখী ইউনিয়নের উত্তর রামশালা গ্রামে। তার বাবা আবু বকর সরদার মালয়েশিয়া প্রবাসী। মা মেরিনা বেগমের সাথে দাম্পত্য কলহের কারণে মিনহাজকে দুই বছরের সন্তান রেখে তার বাবা মালয়েশিয়া চলে যায়। মা মেরিনা বেগম মিনহাজকে সাথে নিয়ে নানার বাড়ি একই উপজেলার আওয়ালগাড়ি গ্রামে আশ্রয় নেয়। সেখানে বসবাসকালে সহায় সম্বলহীন মেরিনা বেগম সন্তান কে বড় করার চিন্তায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
স্বজনরা জানিয়েছেন মিনহাজ গাজীপুরের বড়বাড়ি এলাকায় ‘নিউ কমন্স’ নামক একটি পোষাক কারখানায় হেলপারের চাকরি করতো। তার খালু শাহ পরান বলেন, মিনহাজ তাঁদের সঙ্গে একই বাসার পাঁচতলায় থাকতো। ২০ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে পাঁচতলা থেকে নিচে নামে। এরমধ্যে কোটা বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে ওই এলাকায় সহিংসতা শুরু হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ করেই বাম হাতের কনুই ভেদ করে একটি গুলি তার বাম পাঁজরে এসে লাগে। সেখান থেকে সঙ্গীহীন অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মিনহাজকে মৃত ঘোষণা করেন। পরদিন ২১ জুলাই রবিবার সকালে গ্রামের বাড়ি আক্কেলপুরে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয় তাকে ।
মিনহাজের বড় চাচি ঝর্ণা বেগম বলেন, স্বামী না থাকা সংসারে মিনহাজকে মানুষ করতে অনেক কষ্ট করেছেন মা মেরিনা বেগম। সন্তান বড় হলে সংসারে আর অভাব অনটন থাকবে না বুক ভরা আশা নিয়ে সব কষ্ট চাপা দিয়ে বড় করে তোলেন মিনহাজকে। ঝর্ণা বেগম আরও বলেন মায়ের জন্য কিশোর বয়স থেকে ছেলেটা গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। মাস গেলেই বেতন পাঠাতো। গত ঈদুল আজহার ছুটিতে বাড়ি এসে তার মাকে গাজীপুরে নিয়ে যায়। সেখানে ডাক্তার দেখানোসহ মায়ের নিয়মিত চিকিৎসা শুরু করে মিনহাজ। পরিবারে ওর মা ছাড়া আপন বলতে কেউ নেই। বাবা বিদেশ যাবার পর তাদের খোঁজ খবর রাখে না। কিশোর বয়স থেকেই সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। মাকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না। ওর স্বপ্ন ছিল মাকে ভালো করে বাড়ি নিয়ে আসবে। মা ভালো হলে চাকরি ছেড়ে দিবে। ওর সেই আশা পূরণ হলো না। টাকা অভাবে ওর মায়ের চিকিৎসার এখন দায়ভার কে নিবে।
মিনহাজের চাচাতো ভাই মাহফুজ বলেন,‘মিনহাজ কোন রাজনীতি করতো না। ও গার্মেন্টসে চাকরির জন্যই গাজীপুরে থাকতো। ওইদিন রাস্তায় বের হওয়া মাত্র অজ্ঞাত গুলিতে মিনহাজ মারা যায়। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর