
ইজিবাইক চালানো শেষ করেই রোজ সন্তানের জন্য খাবার নিয়ে তবেই বাড়ি ফিরতো মেহেদী হাসান। এখন সন্ধ্যা হয় কিন্তু খাবার নিয়ে আর বাড়ি ফিরে না মেহেদী হাসান। সন্তানদের অপেক্ষা যেন শেষ হয় না। বড় মেয়ে মেহেরুননেছা বয়স ১০ বছর। আদরের ছোট ছেলে আসিফের বয়স ৫ বছর। সন্ধ্যা হলে বাবার অপেক্ষায় থেকে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়লেও মায়া ভরা মুখে বাবার আদর আর জোটেনা। ৫ আগস্ট জয়পুরহাটে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ইজিবাইক চালক মেহেদী হাসান (২৯)।
ছেলে শোক, বড় শোক। ছাত্র -জনতার আন্দোলনে জয়পুরহাটের ইজিবাইক চালক মেহেদী হাসানকে হারানোর কান্না থামছেই না মা ফাতেমা বেগমের (৬০)।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলে বাড়িতে ইজিবাইক রেখে আনন্দের মিছিলে যোগ দিতে যায় মেহেদী হাসান (২৯)। কে জানে এই যাওয়াই শেষ এবং লাশ হয়ে বাড়িতে ফিরবে মেহেদী। এ কথা গুলো বলতে গিয়ে বার বার আঁচলে চোখ মোছেন মা ফাতেমা বেগম।
জয়পুরহাট শহরের নতুনহাট শেখপাড়া নিবাসী বাবা আলতাফ শেখ মারা যান মেহেদীর মৃত্যুর ৩৯ দিন আগে। স্বামীর মৃত্যুর শোক কেটে উঠতে না উঠতেই ছেলে শোকে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন মা ফাতেমা বেগম। মেহেদী হাসানের স্ত্রী জেসমিন আক্তার বলেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। এমন খবর শুনে সন্ধ্যার আগেই বাড়িতে ইজিবাইক রেখে আনন্দ মিছিলে যোগ দিতে যায় মেহেদী হাসান (২৯)। আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা থানায় আশ্রয় নেওয়ার খবরে ছাত্র-জনতা জয়পুরহাট থানা ঘেরাও করে। এ সময় পুলিশের একটি গুলি এসে মেহেদীর ডান বুক ভেদ করে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়।
রাত সাড়ে ৮ টায় মৃত্যুর সংবাদ পান নিহতের পরিবার। ছুটে গিয়ে পরিবারের সদস্যরা মেহেদীর নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখেন জেলা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। বাবার দেওয়া এক শতাংশ জমির উপর একটা ঘর করে কোন মতে থাকতেন মেহেদী। পরিবারে বৃদ্ধ মা ছাড়াও রয়েছেন স্ত্রী জেসমিন আক্তার এবং দুই সন্তান। বড় মেয়ে মেহেরুননেছা (১০), সে তেঘর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২য় শ্রেণীতে পড়াশুনা করে। ছোট ছেলে আসিফ বয়স ৫ বছর। অবুঝ শিশু মেহেরুননেছা জানায়, রোজ বাবা ইজিবাইক চালানো শেষ করে খাবার নিয়ে বাড়ি ফিরতো। এখন আর আসে না! বাবার অপেক্ষায় থেকে ছোট ভাই আসিফকে নিয়ে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ি।
অভাব অনটনের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন মেহেদী। সংসারের অভাব দূর করতে পাশের ধামইরহাট উপজেলার পূর্ব বাজার দোলা ট্রেডার্স থেকে দেড় বছরের চুক্তিতে এক লাখ অগ্রিম দিয়ে একটি ইজিবাইক কিনে মেহেদী হাসান । কিস্তি পরিশোধ করতে পারবে না এমন ভেবে মৃত্যুর তিন দিন পরেই ইজিবাইকটি নিয়ে যান দোলা ট্রেডার্সের মালিক।
জেসমিন আক্তার বলেন, বিয়ের ১২ বছর ধরে খেয়ে না খেয়ে সংসার করছি। স্বামী মেহেদী ছিল সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমার সংসারে এখন আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। মেহেদীর মৃত্যুর ঘটনায় সহযোগিতায় এগিয়ে আসে জামায়াতে ইসলামের লোকজন। তারা ১ লাখ টাকা সহ এক মাসের খাদ্য সহায়তা প্রদান করেছে বলে জানান জেসমিন আক্তার। তিনি আরও জানান, গুলিতে মেহেদীর মৃত্যুর ঘটনায় আশা এনজিও থেকে নেওয়া ঋণ ১০ হাজার টাকা, বিএস সংস্থা থেকে ৩০ হাজার টাকা, গ্রামীণ ব্যাংক ২০ হাজার টাকা ও টিএমএসএস থেকে নেওয়া ৫৫ হাজার টাকা ঋণ মাফ করা হলেও ইসলামি ব্যাংক জয়পুরহাট শাখা থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ মাফ পাওয়া যায়নি। এরমধ্যে দুই কিস্তি ১৩ হাজার ও জামানতের টাকা ১২০০০/- টাকা পরিশোধ করা হলেও বাকি ২৫ হাজার টাকা মাফ পাচ্ছেন না বলে জানান, জেসমিন আক্তার। এ ব্যাপারে অন্তবর্তীকালীন সরকারের দৃষ্টি কামনা করেন তিনি।
গুলিতে মেহেদী হাসানের মৃত্যুর ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ন্যায্যবিচার চান স্ত্রী জেসমিন আক্তার। তিনি বাদী হয়ে কোর্টে একটা মামলা দায়ের করেছেন।
জেসমিন আক্তার বলেন, স্বামীকে হারানো সংসারে আমার একটা কর্মসংস্থান দরকার তাহলে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে চলতে পারবো। মেহেদীর ভাবী তহমিনা বলেন, এলাকায় অত্যন্ত সৎভাবে চলাফেরা করতো মেহেদী ।
প্রতিবেশী নাসিমা বেগম বলেন, মেহেদী কারও সঙ্গে কোন দিন ঝগড়া করেনি। তাই তাকে সকলেই ভালো বাসতো। পরেরদিন মেহেদি হাসানের নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর