ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) তোফাজ্জল নামে এক যুবকের হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে একমাত্র ছেলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান ফিরোজ কবিরের বাবা ও মা।
শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) বিকালে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার সীমান্ত এলাকায় আমজানখোর ইউনিয়নের জুগিহার গ্রামে প্রতিবেদককে ফিরোজ কবিরের বাবা কাঠমিস্ত্রি ফাইজ উদ্দীন ও মা ফিরোজা বেগম এ কথা বলেন।
ফিরোজের বাবা ফাইজ উদ্দীন জানান, গতকাল স্থানীয়রা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ছেলের ছবি তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের তালিকায় দেখে তাকে জানান। পরে তিনি বাড়ির পাশে স্কুল হাটে গিয়ে দোকানের টিভিতে খবরে ঘটনা সম্পর্কে অবগত হন। এর আগে তার ছেলে ফিরোজ কবির গত ৩ দিন ধরে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
ফিরোজের বাবা আফসোস করে বলেন, আমি আমার পরিশ্রম, জায়গা-জমি বিক্রি করে ফিরোজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি। পড়াশোনা শেষ করে ছেলে বিসিএস ক্যাডার হবে, এই স্বপ্নে সব কষ্ট ভুলে যাই। বাড়ির অবস্থা এত জরাজীর্ণ হওয়ার পরও ওর পেছনে সব ব্যয় করছি। গতকালকে ঘটনা শোনার পর থেকে নির্ঘুম দিন কাটছে। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি সবাই।
ফিরোজের মা ফিরোজা বেগম জানান, ‘মোর বাপ তো সহজ-সরল, এলাকাতে কাকো এরা জোড়ে কাথা কহেনি। সেই ছুয়াডা কাকো মারে ফিলাবে, এইডা মি বিশ্বাস করবা পারছু নি। মোর বাপের মোবাইল বন্ধ, তিনডা দিন গেল কুনো কাথা কহেনি মোর সঙ। মি কেংকরে ধরিম মোর বেটা কাকো মারে ফিলাইজে। যুদি মোর বেটা এমন কাজ করে, তাহলে ওয়াক শাস্তি দোক। না হইলে মোর বেটাক পড়াশোনা শেষ করবা দোক। হামারতো ফিরোজ ছাড়া কুনো সম্পত্তি নাই।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাঁশের বেড়া আর ছাউনি দিয়ে জরাজীর্ণ দুটি ঘরে বসবাস করেন ফিরোজের বাবা, মা ও দুই বোন। ফিরোজের ছোট বোন ফারজিনা আক্তার নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে।
ফারজিনা বলেন, ভাইয়ার এমন খবর শোনার পর থেকে বাবা-মা ভেঙে পড়েছেন। তাকে পড়াশোনা করাতে গিয়ে বাড়ি পর্যন্ত মেরামত করেননি বাবা। গোয়ালঘরের মত ঘরগুলোয় বসবাস করছি। তার ভাই জড়িত না থাকলে হয়রানি মুক্ত রাখার অনুরোধ করেন।
ফিরোজের খবর গণমাধ্যমে আসার পর থেকেই তার বাড়িতে এসে সকাল থেকে ভিড় জমাচ্ছেন স্থানীয়রা। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেধাবী ছিলেন ফিরোজ। এলাকায় তার আচার-ব্যবহারে মুগ্ধ ছিলেন সকলেই। তার এমন খবরে প্রতিবেশীরাও অবাক হয়েছেন।
ঘটনার পর গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফিরোজ তার চাচা আইজ উদ্দীনকে ফোন করেছিলেন। তার চাচা জানান, ফিরোজ তাকে ফোন দিয়ে বাবা ও মাকে সান্ত্বনা দিতে বলেছেন। ঘটনার সময় ফিরোজ টিউশনিতে ছিলেন। বন্ধুরা তাকে ফাঁসিয়েছেন বলে চাচার কাছে দাবি করেছেন। তবে এরপর থেকেই ফিরোজের মোবাইল বন্ধ।
ফিরোজের সঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা করেছেন সহপাঠী শামীম উদ্দীন। গতকালের খবরের তিনিও দুপুরে এসেছেন সহপাঠীর বাড়িতে। তিনি বলেন, স্কুল-কলেজে কোনো ঝামেলায় জড়াতো না ফিরোজ। টিভিতে তোফাজ্জল হত্যায় জড়িতদের সঙ্গে তার ছবি দেখে সকলেই অবাক হয়েছি।
তবে অনেক প্রতিবেশী ঘটনা নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন জঘন্য ঘটনা মেনে নেওয়ার মতো না। আমরা ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার চাই। সেখানে ফিরোজ জড়িত থাকলেও। নাহলে পরিবারটিকে যেন হয়রানি না করা হয়।
ফিরোজ কবির হরিণমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক, রত্নাই বগুলাবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক এবং সমির উদ্দীন স্মৃতি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদ বিজ্ঞান নিয়ে ৪র্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন বলে পরিবার জানিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে গত বুধবার রাতে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে।
মামলার পর মো. জালাল মিয়া, সুমন মিয়া, মো. মোত্তাকিন সাকিন, আল হুসাইন সাজ্জাদ, আহসানউল্লাহ ও ওয়াজিবুল আলম নামে ছয় শিক্ষার্থীকে আটকের পর গণমাধ্যমে আসে ফিরোজের নাম ও ছবি। এরপর থেকে কয়েকদিন ধরে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে ফিরোজের কবিরের এলাকা।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর