ধরুন, আপনি একটি পরীক্ষায় বসেছেন। আপনার লক্ষ্য কী হওয়া উচিত? একজন ছাত্র যে সবসময় প্রথম হয়, একজন যে প্রায়ই শেষের দিকে থাকে, নাকি সেই ছাত্র যে ফেল করে? একটু ভাবুন। এর আগে, একটি বিষয় বলা যাক।
বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। আল্লাহ আমাদের দেশকে এমন প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন, যা পৃথিবীর অনেক স্থানে পাওয়া স্বপ্নের মতোই দুরূহ। আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি অঞ্চল মেধা ও কর্মশক্তিতে ভরপুর। তারা প্রচুর কাজ করতে পারে, আবার আনন্দ উপভোগ করতেও জানে। এমন কোনো গ্রাম বা শহর নেই যেখানে ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, ক্যারাম খেলা হয় না। মানুষজন সিনেমার খবর রাখে, আগ্রহ নিয়ে দেখে। এত মেধাবী ও কর্মঠ জাতি হওয়ার পরও, কেন আমরা পিছিয়ে আছি?
যেমন চকচক করলেই সোনা হয় না, তেমনই বাংলাদেশও সোনার বাংলা হতে পারে না- যদি আমরা নিজেদের দোষত্রুটি না দেখি। আমাদের মাঝে অনেক সময় বিদ্বেষের আগুন জ্বলে ওঠে। সিন্ডিকেট করে দেশকে পঙ্গু করে দেই, চাটুকারিতা করে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করি।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ কবিতায় এই ধরনের চাটুকারিতার এক দুর্ভাগ্যজনক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে ‘তৈল’ বা তেলমর্দন অর্থাৎ খুশি করার প্রবণতা সমাজে অযথা প্রভাব এবং ক্ষমতা অর্জনের পথ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কবিতার মাধ্যমে বোঝা যায়, এই চাটুকারিতা দ্বারা যারা অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তারা প্রকৃত মেধার চেয়ে অনেক বেশি সুযোগ পায়।
অযোগ্যরা যখন উচ্চস্থানে পৌঁছান, তখন তাদের অহংকার ও গর্ব নিজ ব্যক্তিত্বকে ধ্বংস করে। যারা প্রকৃত যোগ্য তারা অবমূল্যায়িত বোধ করেন এবং তোষামোদের অভাবে পিছিয়ে পড়েন।
এ ধরনের পক্ষপাতিত্ব দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক ন্যায়বিচারকে ক্ষুণ্ন করছে, যেখানে প্রকৃত মেধা ও পরিশ্রমের মূল্য কমে যায়।
বাঙালি সমাজে প্রতিশোধ ও হেয় করার মানসিকতা শুধু ব্যক্তিগত অপমান বা প্রতিযোগিতার ফলাফল নয়, বরং তোষামোদি এবং প্রাপ্য ছাড়াই অন্যের চেয়ে উচ্চ স্থানে পৌঁছানোর প্রবণতা থেকেও আসে।
বাংলা সংস্কৃতি গভীরভাবে সম্প্রদায়, ইতিহাস এবং মূল্যবোধ দ্বারা গঠিত হলেও, মানুষের জটিল আবেগ যেমন প্রতিশোধ এবং অন্যদের হেয় করার প্রবণতা মাঝে মাঝে প্রকাশ পায়। ঐতিহ্যগতভাবে, বাঙালিরা তাদের সহানুভূতি, বুদ্ধিমত্তা এবং আতিথেয়তার জন্য গর্বিত, তবে সামাজিক চাপ, ব্যক্তিগত ক্ষোভ বা আহত অহংকার মানুষকে কখনও কখনও প্রতিশোধ নিতে বা অন্যদের হেয় করতে প্ররোচিত করতে পারে। কাউকে ‘শিক্ষা দেওয়ার’ ইচ্ছা প্রায়ই একটি অবমাননা বা অপমান থেকে সৃষ্ট হয়, যা মানসিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে।
যে কোনো পরিস্থিতিতে, আমরা কি সত্যিই তখনই বড় হয়ে উঠি যখন অন্য কেউ ব্যর্থতায় মাটির সাথে মিশে যায়? হোক তা হিংসা, বিদ্বেষ বা অসুস্থ প্রতিযোগিতা। মাটির নিচে কেউ মিশে গেলে, আপনি কেবল তার উপরে দাঁড়ানো মাটি। কিন্তু সেই মাটির গভীরতার বিশালতা কি আপনি একবারও ভেবে দেখেছেন?
চলুন প্রশ্নের মূল বক্তব্যে ফিরে আসি। আমাদের লক্ষ্য কোনো নির্দিষ্ট ছাত্রের ফলাফল হওয়া উচিত নয়। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত পূর্ণ নম্বর—১০০-এর দিকে ধাবিত হওয়া।
পরীক্ষার ফলাফলের চূড়ান্ত মাপকাঠি যদি ১০০ হয়, তবে আমাদের উচিত মেধা, শ্রম, এবং প্রতিভার সর্বোচ্চ প্রয়াস দিয়ে সেই ১০০ নম্বর তাড়া করা। আমাদের পারফরম্যান্স তখনই মাপা হবে, যখন আমরা দেখবো ১০০-এর কতটা কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছি।
যদি সফলতার মাপকাঠি ১০০ নম্বর হয়, তবে কাউকে ছোট করে নয়, তোষামোদ করে নয়, হিংসা কিংবা অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে নয়, বরং সকলেই যদি পূর্ণ নম্বর অর্জনের জন্য একসাথে কাজ করি, তাহলে পৃথিবী স্বপ্নের মতোই সুন্দর হতে পারে। একদিন না একদিন, আমরা সবাই মিলে ১০০ পেতেই পারবো।
লেখক: তাজওয়ার নূর আদিব ভূঁইয়া
প্রকৌশলী
রার/সা.এ
সর্বশেষ খবর
অন্যান্য... এর সর্বশেষ খবর