নিয়োগ বাণিজ্য, অবৈধ বালু ব্যবসা, সরকারি প্রকল্প আত্মসাৎ টেন্ডার বাণিজ্য, পদ বাণিজ্য আর সন্ত্রাসী বাহিনী লালন পালন করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছে মানিকগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সাংসদ নাইমুর রহমান দুর্জয়। ঢাকায় একাধিক বাড়ি, মানিকগঞ্জ শহরে একটি এবং ঘিওর উপজেলার বৈকুন্ঠপুর পুর গ্রামে রয়েছে বাড়ি। এছাড়া নামে বেনামে স্ত্রী এবং তার নিজ নামে দুর্নীতির মাধ্যমে দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছে তিনি।
ইতোমধ্যে দুর্জয় ও তার স্ত্রী ফারহানা রহমানের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক আবুল হাসনাতের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেয় আদালত।
অভিযোগ রয়েছে, এমপি দুর্জয় বাহিনীর আতঙ্কে দিন কেটেছে তার সংসদীয় আসনের মানিকগঞ্জের তিন উপজেলার বাসিন্দাদের। গড়ে তুলেছিলো সন্ত্রাসী বাহিনী। তার একক আধিপত্যে নিয়ন্ত্রণ হতো সকল অবৈধ ব্যবসা আরিচা-কাজিরহাট-নগরবাড়ী নৌ রুটে স্পিডবোট ব্যবসা। প্রভাব বিস্তার করে ওই ঘাটে শুধু তার ৯টি স্পিডবোট চলেছে। দলের অন্য নেতাকর্মীদের স্পিডবোট ঘাটে ভিড়তে দেয়া হতো না। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে স্পিডবোট থেকে প্রতি মাসে ৪ লাখ টাকা বাণিজ্য করতেন এমপি দুর্জয়। নিজ দলের নেতাকর্মীদের স্পিডবোট চালাতে দিতেন না তিনি। দুর্জয় সিন্ডিকেটের ভয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। এছাড়া শিবালয়ের আরিচা পুরাতন টার্মিনালের তিন নম্বর ঘাটের কড়ইতলা এলাকা থেকে ইঞ্জিনচালিত ট্রলার থেকে তার ক্যাডার বাহিনী দিয়ে চাঁদা নিতেন তিনি। তার নির্দেশে প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০টি ট্রলার থেকে ৫০০ টাকা করে চাঁদা তুলতেন বিশ্বজিৎ ও সিকো নামের দুই যুবলীগ নেতা।
মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন সাবেক এই প্রভাবশালী এমপির ঘনিষ্ঠরা। জেলা সেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক আব্দুর রাজ্জাক রাজা গোয়েন্দা সংস্থার তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী। আর এরা দুজন ছিলেন এমপি দুর্জয় বাহিনীর প্রধান। শিবালয় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুসের ছেলে ইমন,অসিউর রহমান সিকো সাবেক এই সংসদ সদস্যের আশ্রয়ে ইয়াবা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন।
অপরদিকে অবৈধভাবে ফসলি জমির মাটি কেটে স্ট্রোন ব্রিকস এককভাবে ব্যবসা করেছেন এমপির চাচাতো ভাই। ঘিওর উপজেলার শত শত বিঘার তিন ফসলি জমি কেটে পুকুরে পরিণত করেছে স্থানীয় সংসদ সদস্য নাইমুর রহমান দুর্জয়ের ভাই মাহবুবুর রহমান জনি ও তাঁর ক্যাডার বাহিনী। স্ট্রোন ব্রিকস শুরু হওয়ার পর থেকে মাটি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নেন এমপি দুর্জয়।
সংসদ সদস্য দুর্জয় বাহিনী ঘিওর উপজেলার বিভিন্ন নদীতে অবৈধ ড্রেজার বাণিজ্য সিন্ডিকেট গড়ে তুলে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। অবৈধ বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ রাখতেন এমপি দুর্জয়ের স্ত্রীর আস্থাভাজন সেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আবুল বাশার। আরিচা পাটুরিয়া ফেরিঘাটে এমপি দুর্জয়ের ছিল অবৈধ বালু ব্যবসা।সাবেক এই প্রভাবশালী এমপি ১০ বছরে তিনটি উপজেলায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে অবৈধ বালু ব্যবসা করে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।
এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ভূরি ভূরি অভিযোগ উঠেছে, তিনি তার দশ বছরের শাসনামলে স্কুল কলেজে করেছে অসংখ্য নিয়োগ বাণিজ্য। তিন উপজেলার স্কুল কলেজে তার হাত ছাড়া কোনো নিয়োগ হয়নি। দৌলতপুর মতিলাল কলেজের লাইব্রেরি ম্যান হিসেবে ৪ লক্ষ টাকা নিয়ে রওশন নামের এক ব্যক্তিকে নিয়োগ দেন দুর্জয়। এছাড়া টেপরী মৌলভি আব্দুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ে গণিত শিক্ষক পদে ৭ লক্ষ টাকা নিয়ে আব্দুল্লাহ আল মামুন নামের আরেক ব্যক্তিকে নিয়োগ দেন এমপি দুর্জয়।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, এমপি দুর্জয় সরকারি টিআর কাবিখা তার পছন্দের লোক ছাড়া কাউকে দিতেন না। যারা টাকা দিতে পারতো তাদের দেয়া হতো সরকারি টিআর কাবিখা। কোন মসজিদ মন্দিরে টিআর কাবিখা বরাদ্দ দিতেন না তিনি।
তিনি বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা নমিনেশন বাণিজ্য করেছেন এমন অভিযোগও রয়েছে। একেক চেয়ারম্যান প্রার্থীদের কাছ থেকে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে নৌকা প্রতিকের নমিনেশন দিয়েছেন তিনি। তিনি সন্ত্রাসী বাহিনী গড়তে বাড়ির কাজের লোক আব্বাসকে বানিয়েছিলেন জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। আরেক কাজের লোক বাচ্চু শেখ নামের ব্যক্তিকে ইউনিয়ন আওয়ামী সভাপতির পদে বসান তিনি। এই দুজনের নিয়ন্ত্রণে ছিল যমুনার চর আলোকদিয়া,বাচামারা, চরকাটারী ইউনিয়ন। দুর্গম এই চরে সরকারি প্রকল্পের বরাদ্দ অনিয়ম দুর্নীতি করতেন এমপির পোষা এই দুই নেতা।
স্থানীয়রা বলেন, দুর্জয় এমপি থাকাকালীন সময় তার মা চাচা এবং তার স্ত্রীর কথা ছাড়া কোন কাজ তো না। সরকারি চাকুরি আর ঝাড়ুদার পদেও চাকরি নিতে গেলে এমপি দুর্জয়ের হাত ছাড়া নিয়োগ হতো না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক,এমপি দুর্জয়ের আস্থাশীল এক ড্রাইভার বলেন, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় এমপি দুর্জয়ের বাসায় বস্তাভর্তি টাকা ছিলো। ওই টাকার গায়ে ফাখন্দ পড়ে গিয়েছিল। সব এক হাজার টাকার নোট ছিল।
মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এস এ জিন্নাহ কবির বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরের মানিকগঞ্জের ঘিওর দৌলতপুর শিবালয়ে কোন ধরনের উন্নয়ন মূলক কাজ হয়নি। বিগত ১৫ বছরের ওই এলাকায় সরকারি প্রকল্পের টাকা হরিলুট করা হয়েছে। সরকারি প্রকল্প এনে তৎকালীন জনপ্রতিনিধিরা তাদের পকেট ভারী করেছে। সাধারণ মানুষের উন্নয়নে কোন কাজ করেনি। আওয়ামী লীগের আমলে ওই মানিকগঞ্জ-১ আসনের জনপ্রতিনিধিরা নদী থেকে অবৈধ বালু ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সরকারিভাবে নদী খননকৃত বালু কারা কীভাবে বিক্রি করেছে তার কোন হিসেবে নেই। সরকারি অর্থায়নে নদী শাসন অর্থাৎ স্থায়ী বাধ নির্মাণ করার নামে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করেছেন জনপ্রতিনিধিরা। এছাড়া ওই এলাকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সরকারি টিআর কাবিখা বরাদ্দ এনে কোথাও কোন কাজ করেনি। কারণ বিগত ১৫ বছরের কোনো উন্নয়ন আমরা দৃশ্যমান দেখছি না।
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নাইমুর রহমান দুর্জয়ের মুঠোফোন যোগাযোগ করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তিনি গত ৫ আগস্টের পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছে বলে জানা গেছে।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর
এক্সক্লুসিভ এর সর্বশেষ খবর