বাংলাদেশের স্বনামধন্য ইসলামি ব্যক্তিত্ব, বিদগ্ধ আলোচক, লেখক ও আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ তরুণ, যুবকদের উদ্দেশে বলেছেন, আমাদের জন্মসূত্রে মুসলিম না হয়ে মুসলিম বাই চয়েজ হতে হবে। মুসলিম বাইচান্স না, মুসলিম বাই চয়েজ হতে হবে। আমাদের বুঝেশুনে মুসলমান না হলে ইসলাম কখনো আমাদের জীবনে থাকবে না।
রোববার (২০ অক্টোবর) ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ ইসলামিক কালচারাল ক্লাবের উদ্যোগে আয়োজিত ‘ফেইথ অ্যান্ড ফিউচার’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। এতে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন ইসলামিক ব্যক্তিত্ব আহমেদ রফিক হাফিজাহুল্লাহ। এসময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের প্রিন্সিপাল কাজী শামীম ফরহাদ, ক্লাব কো-অর্ডিনেটর মো. নুরুন্নবী, প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা। শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে আমাদের ভেতর থেকে মুসলিম হতে হবে কোরআন অধ্যয়ন করতে হবে। বুঝে বা অর্থসহ পড়তে হবে। কারণ কোরআনের চেয়ে প্রভাবক বা শক্তিশালী কোনো গ্রন্থ আর হতে পারে না। অন্য সব গ্রন্থ মানুষের লেখা কিন্তু কোরআন মানুষের নয়, স্রষ্টার বাণী।
রাসুল (সা.) তরুণদের বেশি ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন, স্বপ্ন দেখাতেন– উল্লেখ করে তিন বলেন, প্রিয় নবী (সা.) এর চার পাশে সর্বক্ষণ যারা থাকতেন তাদের মধ্যে অভিজ্ঞরা যেমন থাকতেন তেমনি তরুণরা থাকতেন। বিশ্বে সব শাসকের পাশে থাকেন অভিজ্ঞরা। তরুণদের সংখ্যা তুলনায় অনেক কম দেখা যায়। কিন্তু প্রিয় নবী (সা.) এমন একজন নেতা, শাসক ছিলেন যার চার পাশে আবু বকর, উমরের মতো অভিজ্ঞদের পাশাপাশি বেশি থাকতেন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, বেলাল, আলী, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আম্মার, খাব্বার ওমায়ের মুসাব ইবনে ওমরের মতো টগবগে তরুণরা।
তারুণ্যের গুরুত্ব রাসুলের কাছে কেমন ছিল তা তুলে ধরে শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের সময়, কোনো আহ্বান করার সময়, অ্যাড্রেস করে কথা বলতে গিয়ে রাসুল (সা.) নারীদের ডাকতেন ইয়া মাসারাল নিসা, আর তরুণ সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীকে তিনি ডাকতেন ইয়া মাসারাল সাবাব। হে তরুণ যুবকেরা। বৃদ্ধ বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকদের তিনি সম্মান দিয়ে কথা বলার নির্দেশ দিলেও তরুণদের মতো বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীকে অ্যাড্রেস বা সম্বোধন করে ডাকেননি, আহ্বান করেননি।
তারুণ্য মানে উচ্ছলতা, উন্মাদনা, ভোগবিলাস, পাগলামি, আড্ডা, খেলাধুলা, কোনো কিছুতে সিরিয়াস না হওয়া নয়– উল্লেখ করে এ ইসলামি ব্যক্তিত্ব বলেন, রাসুল (সা.) তারুণ্যের সময়টাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি অন্য বয়সকে জীবনের ক্রিম টাইম বলে উল্লেখ করেছেন। আমাদের জীবনের অংশের বড় মূল্যবান হচ্ছে তারুণ্য। অথচ দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো সমাজ পরিবার মনে করে তরুণরা একটু পাগলামি, উন্মাদনা, বিনোদন, আড্ডা করবেই। তরুণরা যদি ধর্মকর্ম করে দাড়ি রাখে টুপি পরে তাহলে ব্যাপার কি, এই বয়সে এসব কেন। সমাজের মধ্যে একটা বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছে যে এসব যেন বৃদ্ধ বয়সের জন্য তুলে রাখার বিষয়। আমাদের এখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ‘অনেকে হজের মতো ইবাদতের ক্ষেত্রে বার্ধক্যের জন্য অপেক্ষা করেন, তরুণ বয়সে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ করেন না। ধারণা এমন যে তরুণ বয়সে হজ করলে পরে আর কোনো খারাপ কাজ করতে পারবেন না। কিন্তু ইসলামিক জ্ঞান বলছে, খারাপ কাজ আসলে হজের আগেও করা যায় না পরেও করা যায় না।’
শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন কিয়ামতের দিন বিশেষভাবে যে সময়টার জন্য জবাব দিতে হবে তা হচ্ছে তারুণ্য। তারুণ্যের জবাবদিহিতা করতে হবে। বৃদ্ধ হিসেবে কে কি করেছেন সে হিসাব আল্লাহ চাইবেন না। আবার আরশের নিচে ছায়া পাবেন, আশ্রয় পাবেন সেই তরুণরা যারা নিজেদের তারুণ্যকে খারাপ কাজ থেকে রক্ষা করে ইবাদতে কাটিয়েছে। তিনি বলেন, মানুষের বিশ্বাস মানুষকে পরিচালিত করে। ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে বিশ্বাস সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মানুষ ইমানের জায়গায় পরিষ্কার থাকলে, যার মাঝে আখেরাতে তারুণ্য নিয়ে জবাবদিহি করতে হবে ভাবনা আসবে, সেই ইমানদার, বিশ্বাসী মানুষকে পাহারা দেওয়ার জন্য মনিটরিং সিস্টেমের প্রয়োজন হয় না, হবে না। ইমানের তাড়না থেকে কোনো কিছু করলে সেখানেই আনন্দ আসে।
স্বনামধন্য এই ইসলামি আলোচক বলেন, আমাদের হতে হবে সিরিয়াস মুসলিম। ইসলামকে আমাদের জানতে বুঝতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, বিশ্বজুড়ে আমরা আজ জন্মগত মুসলিম হওয়ার কারণে ইসলাম নিয়ে বিশেষ ভাবনা তৈরি হয় না। ইমান সম্পর্কে, বিশ্বাসের ভিত্তি সম্পর্কের ফায়সালা করতে পারি না। আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের কেউ উপাস্য হতে পারবে না। আমাদের ইমানকে বুঝতে হবে। অনেক মানুষ আছেন যিনি নামাজ রোজা, ইসলামের অনেক কিছু করেন কিন্তু বিশ্বাসের জায়গায় তিনি দুর্বল। এমন ব্যক্তির কোনো আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা ইমানদার হতে হবে, আবার কি কারণে খারিজ হতে পারি সে ব্যাপারে আমাদের জানাশোনা রাখতে হবে, পড়াশোনা করতে হবে। ঈমানই আমাদের গন্তব্য ঠিক করবে অথচ সেখানেই আমরা আজ পিছিয়ে আছি।
শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, আমরা যত আধুনিকই হই না কেন, ইসলাম তার চেয়ে এক ধাপ বেশি এগিয়ে। আজ ২০২৪ সালে এসে একজন রিকশাচালকও জ্ঞানের গুরুত্ব বোঝেন। কিন্তু দেড় হাজার বছর আগে জ্ঞানের গুরুত্ব কেউ বুঝতেন না। তখনই ওহি নাজিল হয়েছিল, জ্ঞান আরোহণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে– ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক’। তিনি তরুণদের পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, শৈথিল্য বা দুর্বলচিত্তের কোনো কাজ আল্লাহ পছন্দ করেন না। যে কাজই করেন না কেন, ভালোভাবে করতে হবে। আল্লাহর দাসত্ব করতে হবে। এজন্য লেবাসধারী হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই।
‘তরুণদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। অভিভাবক কেন তার সন্তানকে স্কুলকলেজে দিচ্ছেন, কষ্ট করে লেখাপড়া করাচ্ছেন? অনেক তরুণ প্রশ্ন করলে বলতে পারবেন না। অনেকে হয়ত বলবেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবেন। চামচা কেউ হতে চান না কিন্তু যদি সেটা প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি বা প্রধান উপদেষ্টার চামচা বা পিএস… হবেন? সেটা অনেকে সম্মানের মনে করেন। কিন্তু অগণিত সৃষ্টির স্রষ্টা আল্লাহর দাস হতে পারাটা তো সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সম্মানের হওয়ার কথা। এতে হারানোর কিছু নেই, টেনশন নেই, শুধুই প্রাপ্তি।
সর্বশেষ খবর