বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার পর থেকে গত ছয় দিনে বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জুলাই-অগাস্ট মাসের গণঅভ্যুত্থানে এই ছাত্র সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের ভূমিকার কারণে তাদের বিরুদ্ধে এর মধ্যে একাধিক মামলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেই কী কোন সংগঠনের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা যাবে? আইনে কী রয়েছে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কী বলছেন?
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা বলছেন, আইনানুযায়ী সংগঠন নিষিদ্ধ হোক বা না হোক সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় না। ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ থাকলেই গ্রেপ্তার করা যাবে। একই সাথে সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দিন থেকে যদি ওই সংগঠনের ব্যানারে কেউ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে তবে তাকে গ্রেপ্তার বা শাস্তির আওতায় আনা যাবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে তাদেরকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কোন মামলার আসামি হলে সেই ব্যক্তিদের গ্রেফতার করছে পুলিশ।
প্রায় প্রতিদিনই ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের পুলিশ গ্রেপ্তার করছে। রাজধানী ঢাকায় যাদের গ্রেপ্তার করা হয় পুলিশের পক্ষ থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তা জানানো হয়।
পুলিশ জানিয়েছে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদেরকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে সেক্ষেত্রে তাদেরকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে কোন মামলার আসামি যদি থাকে’।
পুলিশ বলছে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন কোন ধরনের তৎপরতা চালালে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
মি. রহমান বলেন, ‘এখন যদি নিষিদ্ধ ঘোষিত কোন সংগঠন কোন রকমের তৎপরতা চালায় সেক্ষেত্রে তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়। অর্থাৎ কোন ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলে।’
পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি, হল কমিটিসহ মোট ১২ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদেরকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, হত্যার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এছাড়া ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জেলায় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহীতে সরকারি মহিলা কলেজে পরীক্ষার হল থেকে এক ছাত্রলীগ নেত্রীকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি আলোড়ন তুলেছে। বিস্ফোরক মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে।
আইন কী বলছে?
গত ২৩ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯’ অনুযায়ী সরকার সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার এই আইন অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামী, এর অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরকে গত পহেলা আগস্ট নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। একই আইনে আগে হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করা হয়।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলছেন, কারও বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোন অপরাধের অভিযোগ থাকলে গ্রেপ্তার করা যাবে।
‘ওদের বিরুদ্ধে কোন স্পেসিফিক অপরাধের অভিযোগ থাকলে যেমন মারামারি, গুলি করেছে, আগুন জ্বালিয়েছে ওইটার ক্ষেত্রে সংগঠন নিষিদ্ধ হোক বা না হোক কিছু যায় আসে না, গ্রেপ্তার করতে পারবে’ বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. মালিক।
‘ব্যক্তিগত ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ থাকলে ছাত্রলীগ হোক ছাত্রদল হোক অপরাধের জন্য অ্যারেস্ট করতে পারবে। নিষিদ্ধ সংগঠন যদি সাংগঠনিক কাজ করে তখন তাকে অ্যারেস্ট করতে পারবে’ বলেন মি. মালিক।
আরেকজন আইনজীবী সিহাব উদ্দিন খান বলছেন, আগে ছাত্রলীগ করেছে, শুধুমাত্র এই কারণে গ্রেপ্তার করলে সেটা আইনসিদ্ধ হবে না। ছাত্রলীগের পদধারী বা এ সংগঠনের রাজনীতি করলেই গ্রেপ্তার করা যাবে বিষয়টি এমন নয়।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনে যেদিন থেকে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সেদিন থেকে তারা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবে না।
‘নিষিদ্ধ করার পর থেকে যদি সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা তাদের ওই ব্যানারে সংগঠনের কোন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, সভা-সমাবেশ করে বা কোন ধরনের কর্মসূচি দেয় তাহলে শাস্তির আওতায় আসবে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। কিন্তু কমিটিতে থাকলেই গ্রেপ্তার করা যাবে বিষয়টি এমন নয়’ বলেন মি. খান।
উদাহরণস্বরূপ মি. খান বলেন, ফৌজদারি মামলায় যে কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেই গ্রেফতার করা যাবে। যদি কোন ছাত্রলীগ কর্মী কোন হত্যা মামলার আসামি হয় তবে তাকে যে কোনো সময় গ্রেপ্তার করতে পারবে।
এরই মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও জুলাই ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম এ গণগ্রেপ্তার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ছাত্রলীগের কমিটিতে থাকলেই তাকে গ্রেপ্তার সমর্থন করেন না উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের) হলের কমিটিতে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্যই জুলাইয়ের আন্দোলন আগস্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে।
পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘এই ৮০% ছেলের কেউ যদি পূর্বে কোনো অন্যায়ের সাথে জড়িত থাকে তবে তদন্ত সাপেক্ষে তার শাস্তি হোক, কেউ যদি পরে কোনো অন্যায়ে জড়িত হয় তবে তদন্ত সাপেক্ষে তারও শাস্তি হোক। কিন্তু যখন দরকার ছিল তখন রাজপথে নামালাম আর এখন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের পোস্টেড দেখেই গণহারে গ্রেপ্তার হবে এটা কখনোই সমর্থন করি না। এটা হতে পারে না।”
বাঁধন/সিইচা/সাএ