ওয়ান হেলথ ধারণাটি বিশ্বব্যাপী সামগ্রিক স্বাস্থ্য বিশেষ করে সংক্রামক রোগ ও এন্টিমাইক্রোবিয়্যাল রেজিস্ট্যান্সের মতো সমস্যা মোকাবিলায় কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। ওয়ান হেলথ মূলত মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের সমন্বিত সুস্থতার অভিন্ন পথে এগিয়ে চলাকে বুঝিয়ে থাকে।
প্রতিবছর ৩ নভেম্বর বিশ্বজুড়ে পালিত হয় "বিশ্ব ওয়ান হেলথ ডে"। যার মূল উদ্দেশ্য মানুষ, প্রাণী এবং পরিবেশের মধ্যে সুস্থতার গভীর সম্পর্ককে তুলে ধরা।
এবারের প্রতিপাদ্য “The need for One Health approach to address shared health threats at the human-animal-environment interface”- যা এই সমন্বিত স্বাস্থ্য মডেলের গুরুত্ব আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।
দিবসটি উপলক্ষে ওয়ান হেলথের প্রয়োজনীয়তা, বাংলাদেশে ওয়ান হেলথ ধারণার সূচনা ও বিকাশ, মানুষের দেহে প্রাণীর রোগ বা জুনোটিক রোগের প্রভাব, পরিবেশের সঙ্গে সংযুক্ত স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং ওয়ান হেলথের সুফল এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়ে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) ওয়ান হেলথ্ ইনস্টিটিউটের কমিউনিকেশন সেলের সদস্য মো. শাহারিয়ার হোসেন তালুকদার।
ওয়ান হেলথের সংজ্ঞা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে শাহারিয়ার বলেন, ওয়ান হেলথ বলতে মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের স্বাস্থ্যের আন্ত:সংযোগকে বোঝায়। অর্থাৎ মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের সুস্থতা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০২৪ এর তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৭৫% উদ্ভূত সংক্রামক রোগ প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয় যাকে জুনোটিক ডিজিজেস বলে। পোল্ট্রি ও মাংস উৎপাদনে অতিরিক্ত এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে যে এন্টিমাইক্রোবিয়্যাল রেজিস্ট্যান্সের সমস্যা বাড়ছে তা এখন এক বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট।
বাংলাদেশে ওয়ান হেলথ ধারণার সূচনা ও বিকাশ সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ওয়ান হেলথ ধারণার যাত্রা শুরু হয় ২০০৭ সালে যখন দেশে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়। ২০০৭ থেকে ২০১৬ এরমধ্যে দেশের বিভিন্ন পোল্ট্রি খামারে H5N1 ভাইরাসের সংক্রমণে ৫৫৬টি আউটব্রেক ঘটে। এর ফলে খামারগুলোতে হাজার হাজার মুরগি মারা যায় বা আক্রান্ত হয় পড়ে। ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫২টি জেলায় এই ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায় যা বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট স্বাস্থ্য সংকট তৈরি করে। সরকার ও স্বাস্থ্য সংস্থাগুলি ওই সময়েই বুঝতে পারে যে শুধুমাত্র পশু বা মানুষের স্বাস্থ্য দেখভাল করলেই চলবে না বরং তাদের স্বাস্থ্য রক্ষার পাশাপাশি পরিবেশের স্বাস্থ্যকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু),ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলোজি ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) এর যৌথ উদ্যোগে ২০১৫ সালে সিভাসু'র অধীনে ওয়ান হেলথ্ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ইনস্টিটিউটটি গবেষণা ও নজরদারির মাধ্যমে মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের মধ্যে রোগের বিস্তার, এর কারণ ও সমাধান নিয়ে নিরন্তর কাজ করছে।
এন্টিমাইক্রোবিয়্যাল রেজিস্ট্যান্স সম্পর্কে তিনি বলেন, এন্টিমাইক্রোবিয়্যাল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) হলো এমন এক সমস্যা যা বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। সাধারণভাবে, ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনজনিত রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক ওষুধগুলো এখন জীবাণুর বিরুদ্ধে তেমন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারছে না, কারণ অতিরিক্ত ও অপব্যবহারের কারণে এই জীবাণুগুলো প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলেছে।
ওয়েলকাম ট্রাস্ট এবং বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৭ লক্ষ মানুষ এএমআর-এর কারণে মারা যাচ্ছেন। বাংলাদেশে কিছু গবেষণা অনুযায়ী, মুরগি ও গবাদিপশুর চিকিৎসায় প্রায় ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এই অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে যেসব প্রতিরোধী জীবাণু তৈরি হচ্ছে তা শুধু প্রাণী নয় মানুষের দেহেও মারাত্মক রোগ ছড়াতে সক্ষম। আমেরিকার দ্য সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) ও দ্য ফ্লেমিং ফান্ড'স ক্যাপচুরার তথ্য মতে, ২০১৯ সালের এন্টিমাইক্রোবিয়্যাল রেজিস্ট্যান্স সার্ভিলেন্স রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে প্রায় ৭০ শতাংশ সংক্রমণই এএমআর-এর কারণে প্রতিরোধী হয়ে উঠছে যা দেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
মানুষের দেহে প্রাণীর রোগ বা জুনোটিক রোগের প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, জুনোটিক রোগ যেমন অ্যানথ্রাক্স, জলাতঙ্ক এবং ব্রুসেলোসিস প্রমাণ করে যে আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ওয়ান হেলথ পদ্ধতির বিকল্প নেই। ডব্লিউএইচও-র ২০২২ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ জু্নোটিক রোগে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশেও এর প্রভাব দেখা যায়। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় যেখানে মানুষ ও পশু কাছাকাছি থাকে।
এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা সম্পর্কে শাহারিয়ার বলেন, ২০০৭ সালে পোল্ট্রি খাতে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে প্রথম ওয়ান হেলথ বিষয়ক চিন্তার সূচনা করে। সর্বশেষ এপ্রিল ২০২১ এর হালনাগাদকৃত ডব্লিউএইচও-এর তথ্য অনুসারে, ২০০৮ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মানব শরীরে ৮৫৪টি এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমণের ঘটনা নিশ্চিত হয় এবং মৃত্যুহার ছিল প্রায় ৫৩%। ২০১২ সালে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০৮ সালে প্রথম ৮টি হিউম্যান এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা কেইস সনাক্ত করা হয় এবং পরবর্তিতে এমন আরো অনেক সংক্রমণের সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর থেকে দেশের হাসপাতালগুলোতে ইনফ্লুইয়েঞ্জার জন্য রুটিন হাসপাতাল-ভিত্তিক নজরদারি শুরু হয় এবং জনঘনত্বপূর্ণ এলাকায় অনুদৈর্ঘ্য জনসংখ্যা-ভিত্তিক নজরদারি কার্যক্রম চালু করা হয়।
পরিবেশের সঙ্গে সংযুক্ত স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে তিনি বলেন, পরিবেশের স্বাস্থ্য বিশেষত পানি ও বাতাসের দূষণ বিভিন্ন রোগের কারণ হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পানি দূষণের কারণে হেপাটাইটিস, ডায়রিয়া, কলেরার মতো রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে । প্রাণীজ খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জলাভূমি ও মাটির দূষণও ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। ২০২৩ সালের জাতিসংঘ জরুরি শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ বস্তির মানুষের মধ্যে পানিবাহিত রোগের প্রবণতা বেশি। পরিবেশগত স্বাস্থ্যের অবনতি শুধু মানুষ ও প্রাণীর জন্য নয় বরং আমাদের পুরো বাস্তুতন্ত্রের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। প্রাকৃতিক সম্পদগুলোকে সুরক্ষিত রাখা মানে আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎকেও সুরক্ষিত রাখা।
ওয়ান হেলথের সুফল এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ওয়ান হেলথ ভাবনার মাধ্যমে সমন্বিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা এখন সময়ের দাবি। সিভাসু, আইইডিসিআর এবং আইসিডিডিআর,বিসহ অন্যান্য সংগঠনগুলো বর্তমানে এএমআর এবং জুনোটিক রোগের বিস্তার রোধে সমন্বিত গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এন্টিমাইক্রোবিয়্যাল রেজিস্ট্যান্স কমাতে সরকার ও স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর নীতি অনুসারে কৃষি, খাদ্য ও জনস্বাস্থ্য খাতে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা উচিত। ওয়ান হেলথ ধারণার ভিত্তিতে আমরা যদি সকল স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারি তবে এএমআর, জুনোটিক রোগ এবং পরিবেশগত সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে আসবে।
"অভিন্ন সুরে এক সুস্থ পৃথিবীর স্বপ্ন নিয়ে এই বিশেষ দিনে আমাদের ওয়ান হেলথ ভাবনার গ্রহণ ও তা সমুন্নত করার অঙ্গীকার করা উচিত। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর এবং সমন্বিত পৃথিবী গড়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব। “মানুষের স্বাস্থ্য, প্রাণীর স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের স্বাস্থ্য এক অভিন্ন সুরে গাঁথা”। এই সুরটি বজায় রেখে আমাদের সুস্থতা নিশ্চিত করাই হোক আজকের দিনের অঙ্গীকার" শাহারিয়ার হোসেন।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর
ক্যাম্পাস এর সর্বশেষ খবর