নিরীক্ষা বিভাগের তদন্তে মামলার রায় গোপন রাখা, বিধি বহির্ভূত নিয়োগসহ নানা অভিযোগ প্রমাণিত হলেও পাঁচবিবি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ জহুরুল ইসলাম সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনেও কোন ব্যবস্থা গ্রহন না করায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধি-দপ্তরের তদন্তে অনিয়ম ও সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা চিঠিতে বলা হলেও দীর্ঘ দিনেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, কলেজের ম্যানেজিং কমিটির প্রাক্তন সদস্য দেওয়ান সিরাজুল ইসলামের অভিযোগের ভিত্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক সৈয়দ জাফর আলী এবং অডিটর মোঃ ফারুক গাজী ২০০৮ সালের ১০ ও ১১ জুন জেলার পাঁচবিবি মহিলা কলেজটি অনিয়ম গুলো তদন্ত করেন। তাদের দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, অভিজ্ঞতা ব্যতিরেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অধ্যক্ষ জহুরুল ইসলাম সরকার নিজের বেতন করিয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয় অধ্যক্ষ জহুরুল ইসলাম সরকার ১৯৯৬ সালের ২৫ জুলাই পাঁচবিবি মহিলা কলেজে যোগদান করেন।
এই কলেজে যোগদানের পূর্বে তিনি কামদিয়া নূরল হক ডিগ্রী কলেজে ব্যবস্থাপনা বিষয়ের প্রভাষক পদে ১৯৯৪ সালের ৭ ডিসেম্বর হতে ১৯৯৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত চাকুরি করেছেন এবং এমপিও ভুক্ত ছিলেন। ওই কলেজে চাকুরি করা অবস্থায় পাঁচবিবি মহিলা কলেজে অধ্যক্ষ পদে চাকুরির আবেদন করেন। সেই আবেদনে পূর্ব অভিজ্ঞতা দেখানো হয়নি। কিন্তু একই সময়ে অর্থাৎ (১৯৯৪ সালের ৭ ডিসেম্বর হতে ১৯৯৯ সালের ৩০ জুন) পর্যন্ত উভয় কলেজে চাকুরি করেছেন যা গুরুতর অনিয়ম বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। পাঁচবিবি মহিলা কলেজে অধ্যক্ষ পদে ১৯৯৬ সালের ২৫ জুলাই যোগদান এবং ১৯৯৭ সালের ৩০ নভেম্বর বৈধ করণসহ যাবতীয় কার্যক্রম করলেও তিনি পূর্ব প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৯৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বেতন ভাতার সরকারী অংশ গ্রহণ করেছেন যা সম্পূর্ণ অবৈধ বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। পাঁচবিবি মহিলা কলেজে ২০০০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ৬ হাজার ১৫০ টাকার স্কেলে এমপিও ভুক্ত হয়েছেন। নিয়মানুযায়ী উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগের জন্য ১০ বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকা বাধ্যতামূলক।
নতুন প্রতিষ্ঠান হিসেবে অভিজ্ঞতার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে চাকুরির মেয়াদ ১০ বছর না হওয়া পর্যন্ত প্রভাষকের ক্ষেত্রে ৪৩০০-৬৮০০ টাকা স্কেলে বেতন ভাতার অংশ প্রাপ্যতা ছিল। কিন্তু তিনি ২০০০ সালের ১ এপ্রিল হতে ৬১৫০-৯০০০ টাকা স্কেলে বেতন ভাতার সরকারী অংশ গ্রহণ করেছেন। এই অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণসহ তৎকালীন সময়ে অবৈধভাবে গ্রহণকৃত অতিরিক্ত ১ লাখ ৬১ হাজার ৮৯ দশমিক ৫০ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত দেওয়ার কথা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হলেও তা আজও ফেরত দেওয়া হয়নি এবং তদন্ত প্রতিবেদনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে তিনি উচ্চতর স্কেলে সরকারি বেতন-ভাতা গ্রহন অব্যাহত রেখেছেন।
অপরদিকে, মাস্টার্স ডিগ্রী ছাড়া প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়ার কোন বিধান না থাকলেও স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের পূর্বেই শুধু উচ্চ মাধ্যমিক পাশ সনদের ভিত্তিতে জীববিদ্যা প্রভাষক পদে শশাঙ্ক সরকার, ইতিহাস প্রভাষক পদে কামরুন নাহার ও জাকির হোসেনকে প্রভাষক কৃষি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে । কামরুন নাহার ও জাকির হোসেন দুজনেই হচ্ছেন অধ্যক্ষ জহুরুল ইসলাম সরকারের বোন ও ভগ্নিপতি। এ রকম খালা, মামা ও চাচাতো ভাইসহ ৭ জন আত্মীয় ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন বলে কলেজ সূত্রে জানা গেছে।
এছাড়াও শুধু অনার্স পাশের সনদ দিয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক পদে রবিউল আলমকে ও সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে মুস্তারী আশরাফীকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ঠিক এমনি ভাবে ডিপ্লোমা না থাকার পরেও ফরিদা ইয়াসমিন নামে একজনকে প্রভাষক সাচিবিক বিদ্যা বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াই ২০ জন শিক্ষককে বিধিবহির্ভূত ভাবে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখসহ এসব শিক্ষকের ব্যাপারে তদন্ত প্রতিবেদনের পর্যালোচনায় বলা হয় ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যাহা শিক্ষা নীতিমালা ও বিধির পরিপন্থি। যেহেতু তাদের নিয়োগ যথাযথ হয়নি সে কারণে তাদের গৃহীত সরকারি বেতন ভাতা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত যোগ্য বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
অপরদিকে, হাইকোর্টের রায়কে গোপন রেখে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীর যোগ- সাজসে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মোঃ জাকির হোসেন, প্রভাষক (কৃষি), শশাঙ্ক সরকার, প্রভাষক (জীববিদ্যা) মোছা. কামরুন নাহার, প্রভাষক (ইতিহাস) এবং মুস্তারী আশরাফী, প্রভাষক (সমাজ বিজ্ঞান) কে প্রভাষক পদ হতে “সহকারী অধ্যাপক” পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ওই চারজন ২০১১ সালে হাইকোর্টে প্রভাষক পদ হতে “সহকারী অধ্যাপক” পদে পদো- উন্নতি চেয়ে রিট পিটিশন দায়ের করেন (রিট নং- ৮৭৭২/২০১১)। ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ওই রিট পিটিশনটি যথাযথ ভাবে উপস্থাপন হয়নি মর্মে (হাইকোর্ট সংবিধানের ১০২ ধারায়) মামলাটি খারিজ করে দেয়। রিট পিটিশনটি খারিজ হওয়ার পরেও ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রভাষক পদ হতে “সহকারী অধ্যপক” পদে পদোন্নতি দেখানো হয়েছে যা এখন পর্যন্ত বহাল রয়েছে।
অত্র কলেজের অপর চার জন শিক্ষক ২০১১ সালে প্রভাষক পদ হতে “সহকারী অধ্যাপক” পদে পদোন্নতি পাওয়ার লক্ষ্যে হাইকোর্টে রিট পিটিশান দায়ের করেন (রিট পিটিশান নাম্বার ৩২৪৩/২০১১)। এই চার জন শিক্ষক হচ্ছেন রবিউল আলম, ফরিদা ইয়াসমিন, আনোয়ারুল ইসলাম ও এটিএম রাজিউর রহমান। ২০১১ সালের ২৫ জুলাই হাইকোর্ট বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশ দিলে উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে অধ্যক্ষ জহুরুল ইসলাস সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আপিলটি খারিজ করে দিলেও আপিল নিষ্পত্তির পূর্বেই ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এমপিওতে ওই চার জন শিক্ষকের মধ্যে অনৈতিক সুবিধার মাধ্যমে দুই জন শিক্ষককে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এরা হচ্ছেন রবিউল আলম প্রভাষক ব্যবস্থাপনা ও ফরিদা ইয়াসমিন প্রভাষক সাচিবিক বিদ্যা। এ ব্যাপারে রবিউল আলম বলেন, আমরা মামলা করেছিলাম। ওই মামলায় রায় পেলেও অধ্যক্ষ জহুরুল ইসলাম রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলেও তা খারিজ হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে চার জন শিক্ষকের মধ্যে দুই জনের পদোন্নতি দেওয়া সঠিক হয়নি।
এসব অভিযোগ বিষয়ে কলেজ অধ্যক্ষ জহুরুল ইসলাম জানান, আমার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক আফরোজা আকতার আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে অভিযোগ দিয়েছেন উল্লেখ করে অধ্যক্ষ জহুরুল ইসলাম নিজেকে নির্দোষ দাবী করেন।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর