
সাংবাদিকতা সত্যিই একটি মহান পেশা, যেখানে নেশার মতো কাজ করতে হয় তথ্যের সন্ধানে। এটি শুধু সংবাদ প্রকাশের মাধ্যম নয়, বরং একটি সমাজের আয়না; যেখানে প্রতিটি প্রতিবেদন, প্রতিটি গল্প মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে। সাংবাদিকরা কেবল ঘটনার পেছনে খোঁজ নেন না, বরং তারা দেশ ও সমাজের অবস্থা, সমস্যা এবং সম্ভাবনা তুলে ধরেন। তাদের স্বাধীনতা হলো এই পেশার মূল রক্তবিন্দু, যা তাদেরকে অসাধু কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস দেয়। অথচ কোথাও কোথাও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা চেপে ধরা হয়, সরকার কিংবা শক্তিশালী মহলের কাছে। কিন্তু সাংবাদিকতা কখনো থমকে দাঁড়ায় না—এটি নানা রূপে, নানা শাখায় বিকশিত হয়, যেন সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার অনির্বাচিত এক যাত্রা। প্রতিটি রিপোর্টের মাধ্যমে সাংবাদিকরা আশা এবং পরিবর্তনের বীজ বুনেন, সমাজের কল্যাণে অবদান রাখেন। এই পেশার জাদু হলো, তারা কথা বলেন, যাদের কোনো কণ্ঠ নেই, আর সেই কারণেই সাংবাদিকতা এক মহান সমাজসেবার ধারায় প্রবাহিত হয়।
সাংবাদিকতার ইতিহাস যেন একটি বিস্তৃত সময়ের চিত্রনাট্য, যেখানে মানব সভ্যতার অগ্রগতি এবং চিন্তার মুক্তির চিহ্ন ফুটে ওঠে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯ সালের রোম থেকে শুরু করে ১৭৮০ সালে জেমস অগাস্টাস হিকির "বেঙ্গল গেজেট" প্রকাশ, বাংলা সাংবাদিকতার সূচনা করে; এইসব ধাপে ধাপে সাংবাদিকতা স্রোতের মতো এগিয়ে চলেছে, সমাজের কথা বলার জন্য। তবে যখন আমরা অনলাইন সাংবাদিকতার দিকে নজর দিই, তখন এটি আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে এক নতুন যুগের শুরু। ১৯৯০ সালের দিকে ইন্টারনেটের আবির্ভাব সাংবাদিকতার গতি পরিবর্তন করে দেয়—যেখানে মুহূর্তের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, ২০০৪ সালে "দি ডেইলিস্টার নেট" এবং পরে "প্র থ ম আলো"র অনলাইন সংস্করণ মুক্তির মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই যে সাংবাদিকতা কেবল একটি পেশা নয়, বরং এটি এখন একটি সারা বিশ্বকে সংযুক্ত করার শক্তিশালী মাধ্যম। এই পরিবর্তনগুলো শুধু খবর পৌঁছে দেওয়ার উপায় নয়, বরং এটি মানুষের চিন্তা-ভাবনা, সংস্কৃতি এবং সমাজের চলমান ঘটনাবলীর সঙ্গে যুক্ত হতে সাহায্য করে। সাংবাদিকতার এই রূপান্তর আমাদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে, যেখানে তথ্যের প্রবাহ সহজে, দ্রুত এবং অধিকতর বিস্তৃতভাবে ভাগাভাগি করা যায়।
প্রিন্ট সাংবাদিকতার সীমাবদ্ধতা খুব স্পষ্ট, যেখানে পত্রিকার পাতার বাহিরে খবর প্রকাশ করার সুযোগ থাকে না। কিন্তু অনলাইন পোর্টালগুলো সেই সীমা ভেঙে দিয়ে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছে এক নতুন বাস্তবতা। এখানে খবরের সংখ্যা এবং গুণগত বিশদতা নির্ভর করে সম্পাদকীয় নীতির ওপর। একটি নিউজকে যে কোনো মুহূর্তে, বিশদভাবে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে উপস্থাপন করা যায়—যেমন লেখা, ছবি, অডিও ও ভিডিও—যার ফলে সংবাদ হয়ে ওঠে আরো আকর্ষণীয় এবং জীবন্ত। এভাবে, পাঠকরা শুধু খবরই পড়েন না, বরং সেই খবরের অনুভূতি ও তাৎক্ষণিকতার সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত করতে পারেন।
অনলাইন নিউজের একটি বড় গুণ হচ্ছে তা মুহূর্তের মধ্যেই সারাবিশ্বে পৌঁছে যায়। যেকোনো ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে তা প্রকাশ করা সম্ভব, যা প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য প্রায় অসম্ভব। টেলিভিশন নিউজের ক্ষেত্রে একবার প্রকাশিত হলে নিউজটি আর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, কিন্তু অনলাইনে তা চিরকালীন, আর্কাইভ থেকে সহজেই উদ্ধার করা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আজকের সংবাদ অত্যন্ত কার্যকরভাবে এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, যা সত্যিই তথ্যের একটি বিপ্লব।
অংশগ্রহণমূলক সাংবাদিকতা অনলাইনে একটি নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছে, যেখানে পাঠকরা তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারেন। নিউজের নিচে মন্তব্য করার সুযোগ দিয়ে, তারা নিজেদের চিন্তা ও অনুভূতি ভাগ করে নিতে পারে। এতে করে সাংবাদিকতা শুধু তথ্যের আদান-প্রদান নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে, যেখানে পাঠকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। পূর্ণাঙ্গ ও সমৃদ্ধ সংবাদ প্রকাশের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর জুড়ি নেই, কারণ এখানে সংবাদে সময়ের কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই—এবং তথ্যের প্রবাহ কখনো থেমে থাকে না।
অনলাইন সাংবাদিকতার নানা সুবিধা থাকলেও এর সঙ্গে অনেক সমস্যাও রয়েছে, যা বর্তমান মিডিয়া পরিসরকে সংকটময় করে তুলেছে। প্রথমত, আমাদের দেশে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের জন্য এখনও একটি সঠিক নীতিমালা তৈরি হয়নি, ফলে অনলাইনে খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে নিয়মনীতি ও দায়িত্ববোধের অভাব দেখা দিচ্ছে। দেশে প্রায় দশ হাজার অনলাইন নিউজ পোর্টাল থাকলেও এর মধ্যে মাত্র দুই হাজারের মতো নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। যে কেউ চাইলে অনলাইন পোর্টাল খুলে সংবাদ প্রকাশ করতে পারেন—এটি আসলেই বিপজ্জনক। এভাবে তথ্যের অপব্যবহার ও অসৎ উদ্দেশ্যে নিউজ প্রকাশের সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যেখানে অপসংস্কৃতি ও মিথ্যাচার সহজে প্রবেশ করতে পারে।
অনেক সাংবাদিক ভিন্ন উদ্দেশ্যে অনলাইন পোর্টাল তৈরি করেন, যেখানে গুজব ছড়ানো কিংবা কাউকে হেনস্তা করা হয়। হলুদ সাংবাদিকতা, যা মূলত অসাধু প্রক্রিয়ার একটি অংশ, এখানে গুজব ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য একটি হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি, সাংবাদিক হিসেবে নিবন্ধনের প্রয়োজন না থাকায়, অনেকেই অজ্ঞতা বা অভিজ্ঞতার অভাবে দায়িত্বশীলতার অভাব দেখান। এর ফলে, পাঠকরা সঠিক তথ্য থেকে বঞ্চিত হন, এবং গণমাধ্যমের প্রতি তাদের বিশ্বাস হারাতে শুরু করেন। এই পরিস্থিতি সাংবাদিকতার মর্যাদা এবং পেশাদারিত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে।
এছাড়া, আমাদের দেশে অনলাইন সাংবাদিকতা নিয়ে সঠিক বিজনেস মডেল এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানও কম। একাধিক পোর্টাল দুই-একজন সাংবাদিক নিয়ে কাজ করে, কিন্তু তাৎক্ষণিকতা ও প্রতিযোগিতার চাহিদা মেটানো তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে, সংবাদের গুণগত মান কমে যায় এবং জনসাধারণের বিশ্বাসের জায়গায় একটি বড় ফাটল সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে, হেডলাইন তৈরির ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন ও বিভ্রান্তি একটি বড় আতঙ্ক হয়ে উঠেছে। অনেক সময় হেডলাইনগুলো এতটাই চমকপ্রদ হয় যে, সংবাদটির মূল তথ্য পুরোপুরি গুলিয়ে যায়—যেমন, কেউ মারা যাওয়ার খবর দিতে গিয়ে বলা হয়, "একজন মারা গেছে," অথচ তিনি সিনেমার দৃশ্যে মারা গেছেন। এই ধরনের প্রতারণা জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, যা শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকতার আস্থার ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়।
মানবজীবনের আদর্শিক মানদণ্ড হলো নৈতিকতা, যা আমাদের ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় নির্ধারণ করে। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নৈতিকতার গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু বর্তমান সময়ে অনলাইন সাংবাদিকতা প্রায়শই নৈতিকতার প্রশ্নে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। অনেক ভালো পোর্টাল ও সাংবাদিক থাকলেও, সুমিষ্টভাবে সমষ্টিগত নৈতিকতার অভাব রয়েছে। এর ফলে, সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে, যা সাংবাদিকতার মর্যাদাকে কমিয়ে দিচ্ছে।
বর্তমানে অনলাইন পোর্টালগুলো এলোমেলোভাবে গড়ে উঠছে, যেখানে বিনিয়োগের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি নেই। সবাই যার মতো সংবাদ প্রকাশ করে চলেছে, এবং এর ফলে তথ্যের সঠিকতা ও দায়িত্বশীলতা হারিয়ে যাচ্ছে। যদি আমরা এই অনিয়মিত ও অস্থিতিশীল পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি এবং একটি শক্তিশালী নীতিমালা প্রতিষ্ঠা না করতে পারি, তাহলে অনলাইন সাংবাদিকতা সত্যিই এক বড় হুমকির মুখে পড়বে। মানবসম্পদ ও প্রযুক্তির এই যুগে, সাংবাদিকতার নৈতিকতা রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব—এটি শুধু একটি পেশার জন্য নয়, বরং সমাজের সুস্থতার জন্যও অপরিহার্য।
বর্তমানের অনলাইন সাংবাদিকতা অল্প শিক্ষিত, অসৎ এবং সুবিধাবাদী মানুষের প্রাচুর্যতায় দিন দিন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের শাসনে সাংবাদিকতার মান নেমে গেছে অত্যন্ত নিম্নে; সাংবাদিকরা হয়ে পড়েছেন সরকারের হাতের পুতুল, যেখানে তাঁদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে, এবং সাহসী বক্তব্য রাখার জন্য তাঁদেরকে নিপীড়িত হতে হয়েছে। আইসিটি আইনসহ অন্যান্য নীতি-নিষেধ সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে, ফলে সত্য প্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। এ অবস্থায় মানুষ পরিবর্তিত বাংলাদেশে পরিবর্তিত সাংবাদিকতা দেখতে চায়—একটি সাংবাদিকতা, যেখানে সংবাদমাধ্যম দেশের আয়না হিসেবে কাজ করবে এবং সত্যিকারের দেশের চিত্র ফুটিয়ে তুলবে।
সেখানেই অনলাইন সাংবাদিকতার প্রাধান্য। একটি শক্তিশালী নিবন্ধন প্রক্রিয়া ও সঠিক নীতিমালা তৈরি হলে, অনলাইন সাংবাদিকতা হতে পারে সমাজের উন্নয়ন ও ন্যায়বিচারের জন্য একটি বড় হাতিয়ার। এটা এক পরিবর্তিত বাংলাদেশের সূচনা করবে, যেখানে সাংবাদিকরা নিজেদের পেশাগত নৈতিকতা বজায় রেখে সত্য ও তথ্য পরিবেশন করবে, এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে। পরিবর্তিত সময়ে, অনলাইন সাংবাদিকতা যেন হয়ে ওঠে সৃজনশীলতার প্রতীক, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতিফলন, এবং মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব রূপায়ণ।
লেখক: মাহবুব নাহিদ
কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট
(খোলা কলাম বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বিডি২৪লাইভ ডট কম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)
সর্বশেষ খবর