
মাঠে-মাঠে সোনালী ধান দোল খাচ্ছে মৃদু শীতল বাতাসে। চারদিকে নতুন ধানের সোনালী ঘ্রাণ। চলছে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের ধুম। নতুন এই ধান ঘরে তোলার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব।
বাংলা অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিন (শনিবার) কৃষকদের এই আনন্দ উদ্যাপন করতে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার কাউটিয়া গ্রামে পালিত হয়েছে নবান্ন উৎসব। প্রাকৃতিক কৃষির উদ্যোক্তা দেলোয়ার জাহানের প্রাকৃতিক কৃষি খামারে এই নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। এসময় সারাদেশ থেকে আগত কৃষক এবং দর্শনার্থীরা গ্রামীণ এই নবান্ন উৎসবকে ধারণ করতে প্রকৃতি এবং ঐতিহ্যের মিশ্রণে রঙিন হয়েছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গতকাল (১৫ নভেম্বর) থেকেই এই প্রাকৃতিক কৃষি খামারে সারা দেশ থেকে কৃষি সচেতন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ প্রাণ বৈচিত্র্য খামারটিতে নবান্ন উৎসব উপলক্ষ্যে এসেছেন। ভোরের সূর্য উকি দেওয়ার সাথে-সাথে ধান কাটতে ব্যস্ত হয়ে পরেন কৃষক-কৃষাণীরা। এদের সাথে যুক্ত হন আগত কৃষিপ্রেমী নারী-পুরুষ। জমি থেকে ধান তোলার পর চলে মারাইয়ের কাজ এবং ওই ধান ঢেঁকিতে ভেঙ্গে রান্না হয় সকালের নাস্তা খিচুড়ি। মাটিতে বিছানো চটে বসে কলাতায় খাওয়া হচ্ছে সেই খিচুড়ি। নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সকলেই বসেছেন একই সাথে। নাস্তা শেষ করে শুরু হয় গ্রামীণ কৃষকের মুখে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী জারি, সারি গান। চারি কি দে বসে সকললেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুনছেন সেই গান। কৃষকের গলার এই গান আর অভিনয় মুগ্ধ করছে জুয়ান-বুড়ো সকলকেই। গান মিলে গেলে গলাও মেলাচ্ছেন কেউ-কেউ।
উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রাকৃতিক এই খামারে উৎপাদিত পণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র এবং মৃত শিল্পীদের তৈরি যিনিসপত্রের পসরা বসেছে। বিক্রয় কেন্দ্র থেকে নির্ভেজাল মধু, সরিষার তেল এবং দেশী বিভিন্ন জাতের চাওল কিনছেন অনেকে। ঘর সাজাতে কেনা হচ্ছে মাটির তৈরি শৌখিন যিনিপত্র।
কৃষি প্রেমী দম্পতি সাবের হোসেন এবং নীনা খান সন্তানদের নিয়ে এসেছেন নবান্ন উৎসবে। কথা হয় তাদের সাথে তারা বলেন, ‘সার-বিষ মুক্ত কৃষি সবজি আজকাল পাওয়া নাকাল। সামাজিক মাধ্যমে আমরা এই প্রাকৃতিক কৃষির বিষয়ে জেনেছি। অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল এসে দেখার। নবান্ন উৎসব আমাদের সকলকে একত্রিত করতে পেরেছে। সকালে ক্ষেত থেকে ধান কাটা এবং সেই ধান ঢেঁকিতে ভেঙ্গে সেই চাল দিয়ে রান্না করে খাওয়া শীতের সকালে খেতে পারা সত্যিই আনন্দের। ভিন্নমাত্রার এই নবান্ন উৎসব আমাদের নিয়ে গেছে গ্রামবাংলার পুরানো সেই সময়ে। মনে করিয়ে দিচ্ছে ছেলেবেলার স্মৃতি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথে ঢাকার মিরপুর থেকে এসেছেন প্রকৌশলী নাদিয়া জামান তিনি বলেন, ‘নবান্ন উৎসব আমাদের গ্রাম বাংলার ঐহিত্য যা বর্তমান সময়ে হারিয়ে যেতে বসেছে। এখানে এসে সেই হারিয়ে যাওয়া শৈশবের দুর্লভ স্মৃতি মনে পরে যাচ্ছে। মাটি এবং প্রকৃতির আসল স্বাদ পাচ্ছি। এই নবান্ন উৎসবটা ছড়িয়ে পড়ুক দেশব্যাপী এতে করে মাটি এবং মানুষের সাথে যোগসূত্র বাড়বে।’
নবান্ন উৎসবের উদ্যোক্তা দেলোয়ার জাহান বলেন, ‘প্রতিবছরই আমরা এই নবান্ন উৎসব করে থাকি। সারা দেশ থেকে শত-শত কৃষি প্রেমী নারী-পুরুষের সমাগম ঘটে। ঘরে তোলা নতুন ধান দিয়ে পিঠা পুলি উৎসব এবং কৃষকের জারি-সারি গানে মুখরিত থাকে দিনটি। সকলে মিলে ফিরে যাই প্রাচীন এই নবান্ন উৎসবে।’
উল্লেখ্য, দেলোয়ার জাহান ২০১২ সালে কাউটিয়া গ্রামে নিজের কেনা দুই বিঘা জমি নিয়ে গড়ে তোলেন খামারবাড়ি। এরপর স্থানীয়দের কাছ থেকে বর্গা নিয়ে মোট ১৪ বিঘা জমিতে নানা ধরনের ফসলের চাষাবাদ করছেন। প্রাকৃতিক এই খামারটি কৃত্রিম রাসায়নিক সার, বিষ ও হরমোনমুক্ত প্রাকৃতিক কৃষি গবেষণা, কৃষক-কৃষানি শিক্ষণ, উৎপাদন ও বীজ সুরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। এ কাজের মাধ্যমে দেশব্যাপী সচেতন কৃষি উদ্যেক্তাদের নিয়ে দেলোয়ার জাহান রাজধানীর মোহাম্মদপুরে গড়ে তোলেন প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্র।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর