বাংলাদেশের সবজির চাহিদা বিশ্ববাজারে বরাবরই বেশি। নতুন রপ্তানিখাতে সবজির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া এবং ভালোমানের সবজির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। আর শতাধিক রপ্তানিকারক সবজি রপ্তানি করেন চট্টগ্রাম থেকে। সবজি রপ্তানি হয় বেশিরভাগ মধ্যপ্রাচ্যে এবং ইউরোপের কিছু দেশ, আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যে। কিন্তু অতিরিক্ত দামে সবজি কেনা এবং জাহাজ ভাড়া ও বিমান ভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদেশে সবজি পাঠাতে আগ্রহ হারাচ্ছেন রপ্তানিকারকরা। বছরের ব্যবধানে রপ্তানি কমেছে অর্ধেকেরও বেশি।
দুই বছর আগেও যেখানে ৬০ হাজার টন সবজি রপ্তানি হয়েছে সমাপ্ত অর্থবছরে তা নেমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ হাজার টন। অর্থাৎ এই সময়ে শুধু সবজি রপ্তানি কমেছে ৭৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ। গত কয়েকবছরে পরিবহণ খাতের সংস্থাগুলো কোন নোটিশ ছাড়াই ধাপে ধাপে ভাড়া বাড়িয়েছে। যার কারণে রপ্তানি পণ্যের খরচ বেড়ে যাওয়ায় আরো অনাগ্রহী হয়ে পড়ছেন এই খাতের রপ্তানিকারকেরা।
সবজি খাতের সংশ্লিষ্টরা জানায়, দেশীয় বাজারে সবজি বা আলুর দাম বাড়ার পাশাপাশি কনটেইনার বা কার্গো খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। যেমন কলকাতা থেকে দুই আড়াই ডলারে পণ্য যায় লন্ডনে। আর বাংলাদেশ থেকে পণ্য যায় ৫ ডলারের বেশীতে। একই পণ্য বিদেশে দুই দেশের দাম ও আলাদা। এতে ক্রেতা কমে যাচ্ছে। বিমান বা জাহাজের ভাড়া কামানো না গেলে সবজি রপ্তানি আরো কমে যাবে।
সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন ধরণের সবজি রপ্তানি হয় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা দেশে। মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমীরাত, বাহরাইন, কাতার, ওমান, কুয়েত, ইউরোপের যুক্তরাজ্য, ইতালি ও ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেনসহ নানা দেশে সবজি রপ্তানি হয়।
চট্টগ্রাম উদ্ভিদ সংনিরোধ কেন্দ্রের (সমুদ্র বন্দর) তথ্যমতে, সমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ফ্রেশ শাক সবজি (কুমড়া, পাতাকপি, টমেটো) রপ্তানি হয়েছে এক হাজার ৬৬৯ টন, হিমায়িত শাক সবজি ১ হাজার ৪০৬ টন এবং আলু রপ্তানি হয়েছে ১১ হাজার ১২৭ টনসহ মোট সবজি রপ্তানি হয়েছে ১৪ হাজার ২০২ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ফ্রেশ শাক সবজি ৩ হাজার ১৭৬ টন, হিমায়িত শাক সবজি ১ হাজার ১৮৭ টন এবং আলু রপ্তানি হয়েছে ২৯ হাজার ৫৬০ টন সহ মোট ৩৩ হাজার ৯২৩টন।
এদিকে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে তাজা শাকসবজি ৫ হাজার ৫৮২ টন হিমায়িত শাক সবজি ২ হাজার ২৮ টন এবং আলু রপ্তানি হয়েছিলো ৫৩ হাজার ২৪ টনসহ মোট ৬০ হাজার ৬৩৪ টন। অর্থাৎ গত দুই বছরের ব্যবধানে সবজি রপ্তানি কমেছে ৪৬ হাজার ৪৩২ টন বা ৭৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে সব থেকে বেশি রপ্তানি করা হয় আলু। এছাড়া মিষ্টি কুমড়া, পাতাকপি, ফুলকপি, টমেটো, শিম, বেগুন, কাঁকরোল, পটল, কচুরমুখী, লাউ, চাইনিজ ক্যাবলসহ বিভিন্ন সবজি ও শাক রপ্তানি করা হয়। এসব শাক সবজির কিছু ফ্রোজেন করে বিদেশে পাঠানো হয় আর কিছু ফ্রেশ সবজি সাধারণ কন্টেইনারে পাঠানো হয়। মূলত দেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, যশোর, রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা রংপুর, ঠাকুরগাঁও, মেহেরপুর, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সবজি বিদেশে রপ্তানি জন্য সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া দেশের সবজি জাতীয় ফসলের মধ্যে আলুর রপ্তানি বেশী হয়।
চট্টগ্রাম ফ্রেশ ফ্রুটস ভেজিটেবল এন্ড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স গ্রুপের সভাপতি মাহবুব রানা বলেন, ফল বা সবজি বিদেশে রপ্তানির বড় একটি সম্ভাবনাময় খাত ছিল। কিন্তু গত ছয় মাসে ১৭ বার কার্গো বিমান ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। তাই সবজি রপ্তানিতে ধস নেমেছে। বর্তমানে ভারতের মুম্বাই থেকে কানাডায় আকাশপথে পণ্য পাঠাতে প্রতি কেজি সবজিতে খরচ পড়ে বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৭০ টাকা। আর আমাদের বাংলাদেশ থেকে কানাডায় সবজি পাঠাতে খরচ পড়ছে ৭২০ টাকা। সমুদ্রপথেও গুনতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। এত টাকা দিয়ে তো বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব নয়।
মাহবুব রানা বলেন, বিমানে করে সবজি না পাঠিয়ে আমরা সমুদ্রপথে রিফার কন্টেইনারের (রেফ্রিজারেটেড কনটেইনার বা তাপমাত্রা-সংবেদনশীল কনটেইনার) মাধ্যমে পচনশীল কার্গো যেমন ফল, শাকসবজি পাঠানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যে কন্টেইনার এক থেকে দেড় হাজার ডলার ভাড়া ছিল এখন সেই রিফার কন্টেইনারের ভাড়া পাঁচ থেকে ছয় হাজার ডলার। সবজি কৃষক থেকে বেশী দামে কিনে এখন পরিবহণ খরচ অতিরিক্ত বাড়লে সবজি বা ফল রপ্তানিতে আরো ক্ষতি বাড়বে। সেজন্য কার্গো বিমান বা রিফার কন্টেইনারের ভাড়া কমানো গেলে সবজি রপ্তানি কয়েকগুণ বাড়তো।
সার্বিক প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম উদ্ভিদ সংনিরোধ কেন্দ্রের উপপরিচালক ড. মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দর দিয়ে সবজি রপ্তানির পরিমাণ কমেছে। বাড়তি পরিবহণ খরচের কারণে এমনটা হয়েছে। সেটা আমরা অবগত আছি। বিষয়টি সমাধানে আমরা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা বলছি। আমরা ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করে বিদেশে রপ্তানি বাড়ানো জন্য তাগদা দিয়েছি।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর