অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে, ১০০ দিন আগে যাত্রা শুরু করে বিপুল প্রত্যাশার মধ্যে। গণঅভ্যুত্থানের ফলে গঠিত এই সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল আইনশৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা। কিন্তু ১০০ দিন পর সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ প্রতিশ্রুতিগুলোর অধিকাংশ বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
সংস্কারে অগ্রগতি কতটুকু?
রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ শুরু হলেও এটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। কমিশনগুলোর প্রতিবেদন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর সংস্কারের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কার উদ্যোগে কিছু অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে, তবে এটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে গত আগস্টে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্র সংস্কারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, এবং প্রধানমন্ত্রী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশকে একটি নতুন কাঠামোতে গড়ে তোলা হবে, যেখানে জনগণ সত্যিকার অর্থে সব ক্ষমতার উৎস হবে ।
এ লক্ষ্যে, সরকারের পক্ষ থেকে কয়েকটি কমিশন গঠন করা হয়েছে: সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, ও জনপ্রশাসন সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়। পরবর্তীতে, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, শ্রমিক অধিকার এবং নারী বিষয়ক সংস্কারের জন্য আরও চারটি কমিশন যুক্ত করা হয় ।
এখন কমিশনগুলোর কাজ চলছে এবং ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রতিবেদন পাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সংস্কারের কাজ শুরু হবে। সংস্কারের শেষ সময়সীমা ঘোষণা করা হয়নি, এবং এই প্রক্রিয়া কতদিনে শেষ হবে, তা স্পষ্ট নয়।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ কতদূর?
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ১০০ দিনে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জনগণের হতাশা স্পষ্ট। বাজারে প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম, বিশেষ করে তেল, চিনি, এবং ব্রয়লার মুরগির দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। যদিও আলু ও পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমেছে, তা সামগ্রিক চাপ লাঘব করতে পারেনি। বাজার সিন্ডিকেট ভাঙার উদ্যোগ নেয়া হলেও এর কার্যকর ফল এখনও দৃশ্যমান হয়নি।
সরকারি উদ্যোগ হিসেবে নির্দিষ্ট স্থানে পণ্যের প্যাকেজ বিক্রির ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, যা কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে। তবে, বাজারের পুরো চেইন ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব স্পষ্ট। বিশেষজ্ঞরা শুল্ক কমিয়ে আমদানি বৃদ্ধি এবং পণ্যের সরবরাহ চেইন তদারকির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।
সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের বক্তব্য অনুযায়ী, মূল সমস্যাগুলি সরবরাহ ঘাটতি এবং পরিবহন খরচের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে। সুতরাং, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আরও শক্তিশালী ও সুসমন্বিত পদক্ষেপের প্রয়োজন বলে ধারণা করা হচ্ছে ।
আইনশৃ্ঙ্খলার কী অবস্থা?
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ১০০ দিনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে ব্যাপক অস্থিরতা এবং থানাগুলোতে হামলা ও লুটের ঘটনা ঘটে। নতুন সরকার প্রথম থেকেই পুলিশের মনোবল পুনরুদ্ধার ও কার্যক্রম সচল করতে নানা পদক্ষেপ নেয়। বেশিরভাগ থানায় রদবদল এবং ঢেলে সাজানোর মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীকে পুনরায় সক্রিয় করা হয়, যা আইনশৃঙ্খলা কিছুটা স্বাভাবিক করতে সাহায্য করেছে ।
তবে, পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন শিল্প খাতে শ্রমিক অসন্তোষ এবং সংঘর্ষ এখনো একটি বড় সমস্যা। শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার কারণে কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এছাড়া, কিছু এলাকায় সহিংসতা ও ডাকাতির ঘটনা এখনও জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে ।
এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার সমন্বিত পদক্ষেপ নিচ্ছে, তবে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী আরও কার্যকর এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধান এখনো প্রয়োজন। বিশেষ করে দেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে আরও দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।
নির্বাচনের অগ্রগতি কতটুকু?
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ১০০ দিনে নির্বাচনের অগ্রগতি সীমিত বলে প্রতীয়মান। সরকার নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় ধীরগতি রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত থাকায় নিরপেক্ষ নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
নির্বাচনী সংস্কার বিষয়ে কিছু অগ্রগতি হলেও, তা জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। পর্যবেক্ষকরা দ্রুত পদক্ষেপের মাধ্যমে সংকট নিরসনের আহ্বান জানিয়েছেন ।
‘গণহত্যার’ বিচার
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত গণহত্যার বিচারকাজ শুরু হয়েছে। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই বিচার প্রক্রিয়ার আওতায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনের নামে ব্যাপক সহিংসতা এবং হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল, যার ফলে বহু মানুষ হতাহত হয় এবং স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করে ।
বর্তমানে তদন্ত ও সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া চলছে। অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এবং অন্যান্য সন্দেহভাজনদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এই বিচার দ্রুত ও কার্যকরভাবে সম্পন্ন করতে সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা রয়েছে। অনেকেই এ বিচারকে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন ।
বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ:
সংস্কারের বর্তমান অগ্রগতি ধীর এবং আংশিক। বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য পূরণে আরও কার্যকর নীতিমালা ও দ্রুত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া প্রয়োজন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ানো না গেলে দীর্ঘমেয়াদে ফলাফল আসবে না।
বাঁধন/সিইচা/সাএ
সর্বশেষ খবর