• ঢাকা
  • ঢাকা, বুধবার, ২০ নভেম্বর, ২০২৪
  • শেষ আপডেট ২ মিনিট পূর্বে
মাহামুদ হাসান প্রিন্স
চা বাগান ব্যবস্থাপক ও গবেষক
প্রকাশিত : ২০ নভেম্বর, ২০২৪, ০৯:৪৫ রাত
bd24live style=

মুদ্রা হিসেবে চায়ের ব্যবহার: ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায়

ফাইল ফটো

“আসাম দেশের চা বাগানে, গাছ ঝাঁকালে পয়সা পরে!” আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে ব্রিটিশ সাহেবরা এমন মুখরোচক কথা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রচার করে। এমন লোভনীয় প্রচারণায় প্রলুব্ধ হয়ে তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের নানা প্রদেশ থেকে লাখ লাখ হতদরিদ্র মানুষ নিজেদের ভাগ্য বদলের আশায় আসাম ও সিলেটের চা বাগানে পাড়ি জমায়। মূলত আসাম ও সিলেটের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় নতুন নতুন চা বাগান সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক সংগ্রহ করাই ছিল এমন মুখরোচক গুজব প্রচারের প্রধান উদ্দেশ্য। বাস্তবে চা গাছে টাকা না ধরলেও, মুদ্রা বা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে চা পাতার ব্যবহারের এক সুপ্রাচীন ও প্রসিদ্ধ ইতিহাস রয়েছে, যা আমাদের অনেকেরই অজানা।

কর্মব্যস্ত জীবনের ক্লান্তি দূর করতে, প্রিয়জনদের সাথে গল্প-আড্ডায় কিংবা অতিথি আপ্যায়নে আমাদের সবচেয়ে পছন্দের পানীয় হচ্ছে চা। তবে শুধু সামাজিক গুরুত্ব বিবেচনায় নয়, চায়ের অর্থনৈতিক গুরুত্বও অপরিসীম। তেমনি এক চমকপ্রদ ইতিহাস হচ্ছে- অর্থনৈতিক মুদ্রা হিসেবে চা পাতার ব্যবহার।

মুদ্রা বা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে চা পাতার ব্যবহারের ইতিহাস হাজার বছরেরও বেশী পুরোনো। মূলত চীনের সীমান্তবর্তী পাহাড়ি অঞ্চল, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, তুর্কমেনিস্তান, সাইবেরিয়া, ভুটান এবং ভারতের লাদাখের মতো শীতপ্রধান অঞ্চলে চা-কেন্দ্রিক মুদ্রাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। মুদ্রা হিসেবে চায়ের ব্যবহার সর্বপ্রথম শুরু হয় চীনে (নবম শতাব্দীতে)। তৎকালীন সং রাজবংশের সম্রাটেরা মুদ্রা হিসেবে চায়ের প্রচলন প্রথম শুরু করেন। সে সময় চা ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। শুধুমাত্র ধনী লোকেদেরই চা কেনার মতো সক্ষমতা ছিল। ইংরেজিতে এই মুদ্রাকে বলা হতো “টি-ব্রিকস” বা “টি-ট্যাবলেট”। চা-মুদ্রা বা “টি-ব্রিকস” তৈরি করার জন্য প্রথমে চা পাতা সংগ্রহ করে বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হতো এবং বিশেষ ছাঁচের মধ্যে রেখে শক্ত ইটের মতো আকৃতি দেয়া হতো। এরপর সেই চা পাতা দিয়ে তৈরি ইটগুলোতে রাষ্ট্রীয় সিলমোহর দিয়ে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

চীনের ঐতিহাসিক নথি থেকে জানা যায়, তৎকালীন চীনা সম্রাট দেশের জনগণের কাছ থেকে “চায়ের মুদ্রা”র মাধ্যমে খাজনা আদায় করার জন্য সেসময় সরকারি আদেশ জারি করেন। চায়ের মুদ্রার মাধ্যমে খাজনা আদায়ের এই নিয়ম পরবর্তী কয়েক শত বছর টিকে ছিল। শুধু খাজনা আদায়ই নয়, চীনের ইতিহাস থেকে সেকালের চায়ের মুদ্রার অভিনব ব্যবহারের আরও দারুণ তথ্য জানা গেছে।

সেযুগে মঙ্গোল দস্যুদের বর্বর আক্রমণে পুরো এশিয়াজুড়ে চরম আতঙ্ক বিরাজ করতো। ১০৪৪ খ্রিষ্টাব্দে মঙ্গোলিয়ানদের ভয়াবহ হিংস্রতা থেকে বাঁচতে তখনকার চীনা সম্রাট এক দারুণ কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি মঙ্গোলিয়ানদের জন্য প্রায় ৩০০০০ পাউন্ড বা ১৩,৬০০ কেজি চায়ের মুদ্রা উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন, সেই যুগের বিবেচনায় যা ছিল অত্যন্ত মূল্যবান ও তাৎপর্যপূর্ণ উপঢৌকন। এই বিপুল পরিমাণ চা মুদ্রা উপহার হিসেবে পেয়ে মঙ্গোলিয়ানরা চীনে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকে। সুতরাং বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে চীনের রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সাধারণ জনগণের জানমাল রক্ষায় রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল এই চায়ের মুদ্রা!

আজ থেকে হাজার বছর আগে, চীনের সেনাবাহিনীর জন্য সবচেয়ে ভালো জাতের ঘোড়া সংগ্রহ করা হতো পার্শ্ববর্তী তিব্বত অঞ্চল থেকে। ঘোড়া কেনার জন্য যে বিপুল পরিমাণ ধাতব মুদ্রার প্রয়োজন ছিল তা চীনের সীমান্তবর্তী অতি দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় সহজলভ্য ছিলো না। অন্যদিকে, শীতপ্রধান অঞ্চল হওয়ায় তিব্বতের অধিবাসীদের অতি পছন্দের পানীয় ছিল চা, যা আনতে হতো চীন থেকে। ফলে, চীনের চায়ের মুদ্রার বিনিময়ে তিব্বত থেকে ঘোড়া কেনার প্রচলন শুরু হয়। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ধীরে ধীরে এই চায়ের মুদ্রা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যা পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও।

চীন, তিব্বত এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের যে দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে চায়ের বিনিময়ে ঘোড়া কেনার এই বাণিজ্য সেকালে পরিচালিত হতো, ইতিহাসে তা আজও ‘টি হর্স রোড’ নামে পরিচিত। এই ঐতিহাসিক টি হর্স রোড ধরেই ঘোড়া, উট কিংবা মানুষের পিঠে চড়ে চীনের তৈরি চায়ের মুদ্রা তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া হয়ে তুরস্ক পর্যন্ত পৌঁছে যেতো। মূলত সেই সময়ে ধাতব মুদ্রার দুস্প্রাপ্যতা, টি ব্রিকসের সহজলভ্যতা ও দীর্ঘস্থায়িত্ব এবং শীতপ্রধান অঞ্চলে স্বাস্থ্যকর উষ্ণ পানীয় হিসেবে চায়ের ব্যাপক চাহিদার কারণেই চায়ের মুদ্রা বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে এমন বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল।

তবে সেই যুগে চায়ের মুদ্রার ব্যবহার শুধুমাত্র ঘোড়া কেনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং, ভেড়া, উট, যুদ্ধের তলোয়ার, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সবই চায়ের মুদ্রায় কেনা-বেচা করা যেতো। এ প্রসঙ্গে মুদ্রাবিশারদ উলফগ্যাং বার্চ এর লেখা ‘দ্য ইউস অফ টি ব্রিকস এজ কারেন্সি এমাং দ্য টিবেটানস’ (দ্য টিবেট জার্নাল, ২০০৯, ভলিউম ৩৪, নং ২, পৃষ্ঠা ৩৫-৮০) শীর্ষক নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ১৮শ শতকের শেষভাগে এসেও ৩টি চা-মুদ্রার বিনিময়ে একটি তলোয়ার, ১২ থেকে ১৫টি মুদ্রার বিনিময়ে একটি ভেড়া, ৮০টি মুদ্রার বিনিময়ে একটি ঘোড়া এবং ১২০-১৫০টি চা-মুদ্রার বিনিময়ে একটি উট কেনা যেতো। তিব্বত ও এর নিকটবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলে এই মুদ্রার গ্রহণযোগ্যতা এতটাই বেশি ছিলো যে, কর্মচারী ও শ্রমিকদের বেতন এবং রাষ্ট্রীয় খাজনাও পরিশোধ করা হতো চায়ের মুদ্রায়!

১৭শ শতাব্দীতে তৎকালীন চীনের সম্রাট চায়ের এই মুদ্রা ব্যবস্থাকে মোট ৩টি শ্রেণিতে ভাগ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেসময় ঘোড়া কেনাবেচার জন্য, সরকারি খাজনা পরিশোধের জন্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাবেচার জন্য ভিন্ন ভিন্ন মানের চায়ের মুদ্রার প্রচলন ছিল। তিব্বতে নিযুক্ত ইতালির ধর্মযাজক ডোমেনিকো দা ফানো’র ডায়েরি থেকে ১৭শ শতকের শুরুর দিকে তিব্বতের নানা বিষয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সেখানে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন, ১৭১৩ সালের দিকে তৎকালীন তিব্বতের বাজারে চায়ের মুদ্রা বা টি ব্রিক বেশ কার্যকর ও জনপ্রিয় মুদ্রা হিসেবে প্রচলিত ছিল। উনি নিজেও চায়ের এই মুদ্রা ব্যবহার করেই বাজার থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতেন। এর অল্প কিছুকাল পরেই, ১৮শ শতকের শেষভাগে তিব্বতে সিলভার কয়েন বা রৌপ্যমুদ্রা চালু করা হয়। কিন্তু সাধারণ জনগণের মাঝে মুদ্রা হিসেবে চায়ের জনপ্রিয়তা কোন অংশে কমেনি।

মজার ব্যাপার হচ্ছে- ১৮শ শতকে লাদাখ অঞ্চলে ছোট আকারের এক ধরনের রুপার মুদ্রা চালু করা হয়। সেই মুদ্রার নামকরণ করা হয়েছিল ‘ঝাউ’, যার অর্থ হচ্ছে- ‘অল্প একটু চা’! একথা সহজেই অনুমেয় যে- চায়ের মুদ্রার স্বর্ণালী অতীত স্মরণে রেখেই রুপার মুদ্রার এমন নামকরণ করা হয়েছিল। চায়ের মুদ্রা বিষয়ে আরেকটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হচ্ছে- তিব্বতের বহু মনেস্ট্রি বা বৌদ্ধ মন্দির পরিচালনার খরচ মেটানোর জন্য মনেস্ট্রিতে বিপুল পরিমাণ চা-মুদ্রা সংরক্ষণ করে রাখার প্রচলন ছিল। ১৮৮১ সালের মে মাসে তিব্বতের বাটাং মনেস্ট্রির কোষাগারে তেমনি বিপুল পরিমাণ চা মুদ্রা মজুদ থাকার ইতিহাসও আমরা সেখানকার নথিপত্র থেকে জানতে পারি।

হাজার বছরের বেশি সময় ধরে প্রচলিত এই চায়ের মুদ্রা ব্যবস্থা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চালু ছিল। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র বিশ্বজুড়েই শিল্পক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধিত হওয়ায় চায়ের উৎপাদনও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। একইসাথে চায়ের বৈশ্বিক বাণিজ্য বহুগুণে বেড়ে গিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে চা অত্যন্ত সহজলভ্য ও বহুল জনপ্রিয় পানীয় হিসেবে পরিচিতি পায়। স্বাভাবিকভাবেই ধীরে ধীরে মুদ্রা হিসেবে চায়ের গুরুত্ব কমে যেতে থাকে। একইসাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা অভূতপূর্ব উন্নয়নের কারণে কাগজের মুদ্রা ও ধাতব কয়েনের ব্যবহার বেড়ে যায়। যার ফলস্বরুপ মুদ্রা হিসেবে চায়ের গুরুত্ব একেবারেই কমে আসে। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই চায়ের মুদ্রা সযত্নে সংরক্ষিত আছে তিব্বত, চীন, রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জাদুঘরে। তবে বর্তমান সময়ে মুদ্রা হিসেবে চায়ের গুরুত্ব শেষ হয়ে গেলেও চীন ও তিব্বতের মানুষেরা আজও চা-কে এক অমূল্য সম্পদ হিসেবেই ধারণ করে।

লেখক: মাহামুদ হাসান প্রিন্স
চা বাগান ব্যবস্থাপক ও গবেষক

(খোলা কলাম বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বিডি২৪লাইভ ডট কম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
পাঠকের মন্তব্য:

BD24LIVE.COM
bd24live.com is not only a online news portal. We are a family and work together for giving the better news around the world. We are here to give a nice and colorful media for Bangladesh and for the world. We are always going fast and get the live news from every each corner of the country. What ever the news we reached there and with our correspondents go there who are worked for bd24live.com.
BD24Live.com © ২০২০ | নিবন্ধন নং- ৩২
Developed by | EMPERORSOFT
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ info@bd24live.com
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
ইমেইলঃ office.bd24live@gmail.com