ঢাকার সাভারের তাজরীন ফ্যাশনস ট্র্যাজেডির বিচারহীনতার এক যুগ। আজ রোববার ২৪ শে নভেম্বর ২০১২ সালের এই দিনে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে আগুনে পুড়ে কারখানাটির ১১৭ জন শ্রমিক নিহত হন এবং আহত হন অন্তত ২০০ জন শ্রমিক। সেই দুঃসহ সময়ের স্মৃতি হৃদয় থেকে মুছতে পারেনি অগ্নিকাণ্ডে হতাহত শ্রমিক ও তাদের পরিবার। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পুনর্বাসন সহ সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি একযুগেও। তবে দেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হতাহতের পুনর্বাসন সহ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবেন বলে এমনটাই আশাবাদী ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা।
সরেজমিনে গিয়ে তাজরীন ট্র্যাজেডিতে নিহত ও আহতের পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২৪ শে নভেম্বর মনে করিয়ে দেয় স্বজন হারানোর বেদনা। এই দিনে কেউ হারিয়েছে মাকে, বোনকে, বাবাকে কেউ বা আবার হারিয়েছেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে। এইদিন ডুকরে কেঁদে ওঠে স্বজন হারানো মানুষগুলো। উপার্জনক্ষম মানুষগুলোই এখন তাদের পরিবারের বোঝা, কেউবা কোনোমতে দোকান দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের জীবন যুদ্ধ। কেউবা চিকিৎসা করাতেই নামমাত্র ক্ষতিপূরণসহ শেষ করেছেন তাদের সর্বস্ব। আবার অনেকেই বঞ্চিত হয়েছেন ক্ষতিপূরণ থেকেও। তারা আজ ১২ বছর ধরে অপেক্ষায় আছেন ক্ষতিপূরণের আশায় আর প্রহর গুনছেন পুনর্বাসনের।
শিল্পী বেগম তাজরীনে আহত নারী শ্রমিক কথা হয় তার সাথে। তিনি আক্ষেপ করে জানান, ঘটনার দিন আগুনের লেলিহান শিখা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সিঁড়ি দিয়ে তড়িঘড়ি করে নামছিলেন। হঠাৎ নিচে পড়ে যান তিনি। এতে তার দুই হাত-পা ও মাজায় প্রচণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত হন। পরে দীর্ঘদিন সাভারের পক্ষাগতগ্রস্থদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপিতে চিকিৎসা নিয়ে বেঁচে ফিরে। তবে সে এখন জীবন্মৃত। তবুও সে জীবন যুদ্ধে থেমে নেই। জীবিকার তাগিদে বর্তমানে চায়ের দোকানে চলছে তার সংসার।
তিনি আরও জানান, সরকারসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে সাময়িক কিছু সহায়তা পেলেও পূর্ণাঙ্গ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন পাননি। বহু পরিবার তাদের উপার্জনক্ষম মানুষ হারিয়ে এখন বিপদে পড়েছেন।
আহত আরেক নারী শ্রমিক সবিতা রাণী। কথা হয় তার সাথে। তিনি জানান, তিনি ৩ তলায় কাজ করতেন স্যুইং অপারেটর হিসেবে। চিকিৎসা করাতে করাতে এখন তিনি নিঃস্ব। কোনোরকমে সংসার চলছে তার। কিছু সহায়তা পেয়েছেন তিনি যা দিয়ে চিকিৎসা করাতেই শেষ। বারবার আশ্বাস দিলেও আমাদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন করা হয়নি। ক্ষতিপূরণ পেলে তিনি গ্রামে গিয়ে কিছু একটা করে সংসার চালাবেন বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
মোকাদ্দেছ নামের আরেক আহত শ্রমিক জানান, তিনি ওই কারখানায় স্যুইং অপারেটর ছিলেন। তিনি সহ সকল আহত ও নিহত শ্রমিকদের পুনর্বাসন সহ ক্ষতিপূরণের দাবী জানান।
আহত আরো বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, যাচাই-বাছাই করে তাদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন করার দাবী জানান তারা।
এদিকে, বিভিন্ন শ্রমিক নেতারা বলেন, তাজরীন আগুন লাগার পর কারখানা কর্তৃপক্ষ গেটে তালা লাগিয়ে শতাধিক শ্রমিককে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার ১২ বছর পার হলেও দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হয়নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে মালিকপক্ষের অবহেলায় পোশাকশিল্পে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। অবিলম্বে তাজরীনের ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিতসহ হাসপাতাল বানিয়ে তাদেরকে পুনর্বাসন করে কর্মসংস্থানের দাবী জানান।
স্বদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনে কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি শ্রমিক নেতা মো.ইব্রাহিম বলেন, ২০১২ সালের ২৪ শে নভেম্বর তাজরীন ফ্যাশনস অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি কর্তৃপক্ষ সুপরিকল্পিতভাবে ঘটিয়েছে।
এ ঘটনায় শতাধিক শ্রমিক মারা যায়। আহত হয় আরো অনেক। বিগত সরকারের আমলে আহত শ্রমিকদের সু-চিকিৎসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কিন্তু পূরণ করতে পারেনি। তাই বর্তমান সরকার একটা নিরপেক্ষ সরকার। এই সরকারের কাছে দাবী আহত ও নিহত শ্রমিকদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের দাবী জানাই। সরকার হতাহতদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবেন এমনটাই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
তাজরীণ অগ্নিকাণ্ডের ১২ বছরে নিহত শ্রমিকদের স্বজন, আহত ব্যক্তি, বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা কারখানার ফটকের সামনে এদিন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর