যে মানুষটি অন্যের ক্ষতি করতেন না, পাশের মানুষটিকে ভালো রাখার জন্য নিজে কষ্ট করতেন, তিনি ছিলেন আমার স্বামী জোবায়ের আহমেদ। অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করতেন, অন্যায়ের সঙ্গে তিনি কখনও আপোষ করেননি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শহীদ জোবায়ের আহমেদের স্ত্রী রোববার (১ ডিসেম্বর) তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, আমার স্বামীর দেখানো পথে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ব। সমাজের প্রত্যেকটি স্তরের যেখানে বৈষম্য হবে, সেখানেই প্রতিবাদ করতে হবে। বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়তে হবে। এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়েই আমার স্বামী শহীদ হয়েছেন। স্বামীর হত্যাকারীদের বিচার চাই, স্বামীর দেখানো পথে লড়তে আবারও বই, খাতা-কলম হাতে নিয়েছি। ইচ্ছা আছে ‘আইনজীবী’ হবো।
তিনি হলেন ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার কাউরাট গ্রামের শহীদ জোবায়ের আহমেদের স্ত্রী মোছা. মারজিনা আক্তার। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যূত্থানে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কে উপজেলার কলতাপাড়ায় ২০ জুলাই তিনি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন।
শহীদ জোবায়ের আহমেদের স্ত্রী মোছা. মারজিনা আক্তারের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন পুমবাইল ফজলুল উলুম ফাযিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মো. আব্দুল আলী খান। এ উপলক্ষে তিনি রোববার (১ ডিসেম্বর) তার হাতে শিক্ষা উপকরণ, রেজিস্ট্রেশন কার্ড তুলে দেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঈশ্বরগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, গৌরীপুর উপজেলা প্রেস ক্লাবের আহ্বায়ক মো. রইছ উদ্দিন, মাদরাসার সহকারী অধ্যাপক আব্দুল মতিন, মজিবুর রহমান, আরবি বিভাগের প্রভাষক আবুল কালাম, শহীদ জোবায়েরের শ্বশুর মো. শহীদুল্লাহ, সাংবাদিক আব্দুর রউফ দুদু প্রমুখ।
এ প্রসঙ্গে মাদরাসার অধ্যক্ষ মো. আব্দুল আলী খান জানান, গৌরীপুর নিউজ ডট কমের মাধ্যমে আমরা শহীদ জোবায়ের আহমেদের স্ত্রীর তথ্য পেয়েছি। মারজিনা আক্তার এ মাদরাসায় ১০ম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে গত বছর বিয়ে হয়ে যায়। খবর পেয়ে আমরা তাকে গিয়ে আশ্বস্ত করেছি। এ মাদরাসায় অধ্যয়নকালে কোনো বেতন-ফি দিতে হবে না এবং উচ্চতর শিক্ষার জন্যও আমরা সহযোগিতা করব।
শহীদ জোবায়েরের শ্বশুর মো. শহীদুল্লাহ জানান, জামাইয়ের লাশ দেখেই আমার মেয়ে সজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। প্রায় দুই মাস চিকিৎসায় এখন সুস্থ হয়েছে। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ ও লেখাপড়ার দায়িত্ব নেয়ায় আমরা কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। মাদরাসার গভর্নিং বডির সভাপতি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট লুৎফুন নাহার জানান, মারজিনা আক্তারের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করা হবে। আমরা তার পাশে আছি।
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বড়হিত ইউনিয়নের বৃ-পাচাশী গ্রামের মো. শহীদুল্লাহ’র কন্যা মারজিনা আক্তার জানায়, তিনি অসুস্থ্য হওয়ার পর স্বামীর বাড়ি থেকে তারা পাঠিয়ে দেয়। বাবার টাকায় সুস্থ হলাম। তারপরে তারা (শ্বশুর-শ্বাশুড়ি) কোনো খোঁজ নেয়নি। আমি যাওয়ার পরেও ভালো ব্যবহার করেনি।
তিনি আরও বলেন, ৪ মাস চলে গেলো; আমার তো সব অন্ধকার। স্বামী হারালাম, স্বামীর গৃহও হারালাম। বিয়ের পরে দেয়া স্বর্ণালংকার ছিলো, সবই নিয়ে গেছে। একটু সুখের আশায় সব বিক্রি করে স্বামীর ব্যবসা শুরু করলো। দোকানের মালামাল, জিনিসপত্র, সহায়-সম্পদ সবই তাদের হয়ে গেলো। আমি তো এখন শূন্য! স্বামীর সম্পদ বলতে, তার ঘ্রাণ নেয়ার জন্য ‘বিয়ের পাঞ্জাবি’টা, একটি টি-শার্ট আর একটি টাওয়াল’ নিয়ে এসেছি।
মারজিনা আক্তার বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে আমার স্বামী শহীদ হলো, এখন তো আমিও বৈষম্যের শিকার হয়েছি। আমার স্বামী হারিয়েছি, আমি তো সব হারিয়েছি, নিঃস্ব হয়ে গেছি!
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যূত্থানে ২০ জুলাই গৌরীপুরের কলতাপাড়ায় ৩ জন শহীদ হন। তারা হলেন ডৌহাখলা ইউনিয়নের চুড়ালী গ্রামের বাবুল মিয়ার পুত্র বিপ্লব হাসান (১৯), রামগোপালপুর ইউনিয়নের দামগাঁও মধ্যপাড়ার আব্দুল হালিম শেখের পুত্র নুরে আলম সিদ্দিকী রাকিব (২২) ও মইলাকান্দা ইউনিয়নের কাউরাট গ্রামের মো. আনোয়ার উদ্দিনের পুত্র জোবায়ের আহমেদ (২২)। কোটা বিরোধী প্রত্যেকটি আন্দোলনে অংশ নিয়ে নিজের দোকান বন্ধ করে ময়মনসিংহ চলে যেতেন জোবায়ের আহমেদ। তবে স্ত্রী নিকট বলতেন খেলতে যাত্রী। ২০২৩ সালের জুন মাসে জোবায়ের-মারজিনার বিয়ে হয়। এ আন্দোলনে অংশ নিতে স্ত্রীকে বলতেন খেলতে যাবেন। তার প্রিয় খাবার ছিলো গরুর মাংস আর ডিম। ২০ জুলাই সকালে ছোট মাছের সঙ্গে বেগুন-আলুর তরকারির সাথে ছিলো ডিম ভুনাও। খাওয়া-দাওয়া সেরে কলতাপাড়ার আন্দোলনে যেতে জোবায়ের আহমেদ নিত্যদিনের মতো সকালেই প্রস্তুতি নেন।
এ প্রসঙ্গে মোছা. মারজিনা আক্তার বলেন, আমার নিকট থেকে ৫০ টাকা নিয়ে খেলায় (আন্দোলন) যাচ্ছি বলে বেরিয়ে পড়লো। বললো চিন্তা করো না, চলে আসবো, এখনই চলে আসবো। এলোও, লাল সাইরেন বাজিয়ে, লাশ হয়ে এসেছে। কথাগুলো বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
শহীদ জোবায়ের ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার মইলাকান্দা ইউনিয়নের পূর্বকাউরাট গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোহাম্মদ আনোয়ার উদ্দিনের পুত্র। ৬ কন্যা আর ৩ পুত্র সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন ৮ম। জোবায়েরের বড় বোন উম্মে হানিফ শ্যামগঞ্জ ফাজিল মাদরাসার কামিল পরীক্ষার্থী। সবার ছোট ভাই মো. কাউসার আহমদ একই মাদরাসা থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর