জুলাইয়ে কোটা আন্দোলনের এক পর্যায়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধে সরব হয় দেশের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে প্রশাসনও বাধ্য হয় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনীতি নিষিদ্ধ ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি আবার সরব হয়ে উঠেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা মানের প্রশ্নে অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও নেটিজেনরা ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময়ে চলমান ধারার ছাত্ররাজনীতিকে দায়ী বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন।
আসলেই কি ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে বাঁধা কিনা সে বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতামত তুলে ধরছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিডি২৪লাইভ- এর প্রতিনিধি শেখ সাদী ভূঁইয়া।
'সকল বিশ্ববিদ্যালয় গুলো থেকে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে'
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্যই থাকে গবেষণা ভিত্তিক শিক্ষা প্রদান । এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের ভিতরে একটি সুসম্পর্ক ও স্থিতিশীল পরিস্থিতি প্রয়োজন । কিন্তু বিগত সময়ে আমরা দেখে এসেছি যে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভিতরে রাজনীতি চর্চা ছিল একটি অঘোষিত মুখ্য বিষয়। শিক্ষার্থীরা যেমন শ্রেণিকক্ষের বাইরে রাজনৈতিক কারণে নিজেদের ভিতরে কোন্দলে জড়িয়ে পরতো ঠিক তেমনই শিক্ষকরাও রাজনৈতিক কারণে নিজেদের ভিতরে অন্তঃকোন্দলের ফলে কোরাম তৈরি করতেন। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা পাঠদানের থেকে নিজেদের ভিতরে দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতা বজায় রাখার লড়াইকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। যার ফলশ্রুতিতে গবেষণাসহ পাঠদানে একটি ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটে। অনেকসময় শিক্ষকরা নিজেদের ক্ষমতা বিস্তার ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য শিক্ষার্থীদেরকেও ব্যবহার করেন।
একই বিষয় ছাত্ররাজনীতিতেও লক্ষ্য করা যায় যে , বিগত সময়ে ক্ষমতাসীন দলগুলো তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য শিক্ষার্থীদেরকে ব্যবহার করে এসেছে । ফলস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অবকাঠামোগত উন্নয়নের থেকে রাজনৈতিক বিষয়গুলোর দিকে বেশি মনোযোগ দেয়া হয় ।এমতাবস্থায় সকল বিশ্ববিদ্যালয় গুলো থেকে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে । শিক্ষার্থীরা চাইলে গণতান্ত্রিক উপায়ে রাজনৈতিক চর্চা করতে পারলেও সেটা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও আগামী সরকারেরও উচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের ক্ষমতা লালনের আঁতুড়ঘর না বানিয়ে গবেষণামূলক শিক্ষা বাড়িয়ে বহির্বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিচিতি করানো ।
নওরিন নুর তিষা
শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
'ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি যদি প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতামূলক হয় তবে শিক্ষা ও গবেষণায় উন্নয়ন হবে'
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নয়নে ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষক রাজনীতি উভয়ই প্রভাব ফেলতে পারে। ছাত্ররাজনীতি যখন গঠনমূলক কাজ করবে, তখন এটি ছাত্রদের নেতৃত্বের গুণাবলি, উন্নয়ন এবং সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে সহায়তা করে। তবে, যদি এটি অশান্তি ও সংঘর্ষের দিকে পরিচালিত হয়, তাহলে তা শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে। অন্যদিকে, শিক্ষক রাজনীতি বা গ্রুপিং কখনও কখনও গবেষণায় প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে, তবে এটি যদি সহযোগিতামূলক হয়, তাহলে গবেষণার মান উন্নয়নেও ভূমিকা রাখতে পারে। সুতরাং, শিক্ষার উন্নয়ন নির্ভর করে কিভাবে এই রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তার উপর। তবে, যদি ছাত্র ও শিক্ষক উভয়ই ইতিবাচক এবং গঠনমূলক রাজনীতির দিকে মনোনিবেশ করেন, তবে তারা শিক্ষার পরিবেশকে উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে। সুতরাং, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য এবং পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ।
ওসমান সরদার
শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
'শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি দুটিই বাধা'
শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি দুটিই বাধা। তবে শিক্ষক রাজনীতি বেশি বাধা বলে আমি মনে করি । কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতায় থাকা সরকারের দলীয় শিক্ষক নিয়োগের ফলে যোগ্য শিক্ষকরা সুযোগ পায় না । ফলে শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায় । এছাড়াও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে দলীয় শিক্ষার্থীদের বেশি অগ্রাধিকার দেওয়াটাও এক্ষেত্রে মুখ্য একটি বিষয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের উপর ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকেও তাদের সাথে বৈষম্য করা হয় । ক্লাসে দায়মুক্তি হিসাবে পাঠদান করে অনেক শিক্ষকই সেমিস্টার শেষ করে দেন এতে করে শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়ে যায়। এছাড়াও শিক্ষকদের ভেতরে সবসময় প্রশাসনিক উপরের বিভিন্ন পদগুলোতে যাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। আর্থিক বা ক্ষমতার দিক থেকে তাঁরা নিজেদের স্বার্থটাকেই বড় করে দেখে। সে কারণে শিক্ষার পরিবেশ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।
তাছাড়াও পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে পদোন্নতি না দিয়ে রাজনীতির ভিত্তিতে দলীয় শিক্ষকদের পদোন্নতি দেওয়া হয় । দলীয় রাজনীতি বাস্তবায়ন করার জন্য তারা শিক্ষার্থীবান্ধব না হয়ে রাজনৈতিকবান্ধব হয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে আমরা ৫ই আগস্টের পরে অনেক শিক্ষককে জোরপূর্বক পদত্যাগ করাতে দেখেছি । তাঁরা তাঁদের স্বীয় পদ বাঁচিয়ে রাখতে নৈতিকতাবিহীন আদর্শ বিবর্জিত একজন মানুষ হয়ে যান। যার ফলে তারা শিক্ষক নাকি রাজনীতিবিদ এটাও যাচাই করা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। কিন্তু তাঁদের হওয়া উচিত ছিল একজন শিক্ষার্থীবান্ধব ও গবেষণাধর্মী শিক্ষক । রাজনৈতিক মতের প্রয়োজন আছে তবে সেটা সুস্থ ধারার রাজনীতি। মূলত শিক্ষকদের উপরেই নির্ভর করে ছাত্র রাজনীতি । কারণ তারাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ করে।
আলী জাকি শাহরিয়ার
শিক্ষার্থী, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
'দিন দিন দলীয় রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।' শিক্ষাব্যবস্থা'
দিন দিন দলীয় রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক নিয়োগ থেকেই শুরু হয় এই আখড়া। কেননা এই নিয়োগের বেশিরভাগ হয় রাজনৈতিক বিবেচনা বা সুপারিশে। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকেন সেই মতাদর্শে নিয়োগ হয় শিক্ষকদের। যখন একজন শিক্ষককেই যোগ্যতা অনুসারে স্থান দেওয়া হয় না সেখানে গবেষণার মান শূন্য থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষকদের পরিচয় উঠে আসে তাদের পড়ানোর দক্ষতা, গবেষণার মান, গবেষণার অনুদান, ছাত্রবান্ধবের মাধ্যমে। আমাদের দেশ তার বিপরীত। ২০২৪ সালের বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ে প্রথম ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।
সত্যিকার অর্থে এ ব্যাপারে কারোর কোনো আগ্রহ আছে কি? উত্তর সম্ভবত নয়। কেননা তাঁরা ব্যস্ত উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ডীন, প্রক্টর হওয়ার লক্ষ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শতকরা পাঁচ থেকে ছয় ভাগ শিক্ষক শিক্ষা ও গবেষণার সাথে যুক্ত থাকেন। আর বাকিরা ব্যস্ত বিভিন্ন রাজনীতিতে। এমন শিক্ষক দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার কতটা উন্নতি সম্ভব জানা নেই। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জায়গায় পদত্যাগের হিড়িক লেগেছিল শিক্ষকদের। অনেকেই স্বেচ্ছায় আবার অনেকে চাপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। শিক্ষকদের এমন অপদস্ততার মূল কারণ কি এই শিক্ষক রাজনীতি? শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে সরকার কোনোরকম যাচাই- বাঁচাই না করে সরকারের দালালি করে এমন কিছু শিক্ষকদের বসিয়েছিলেন সেই পদে। সেই শিক্ষক কি সত্য-মিথ্যা যাচাই করবে শিক্ষা ব্যবস্থাপনায়? সত্য কথা উঁচু কণ্ঠে বলবে?
উত্তর না। কারণ দুর্নীতি করে করে যে তাঁরা টাকার পাহাড় জমিয়েছেন। সরকারকে খুশি করতে পারলেই উঁচু পদে পদোন্নতি পেয়েছে। কেউ সত্যি কথা বললে তাঁকে করেছেন বিভিন্নভাবে হয়রানি, করেছেন চাকরিচ্যুত। শিক্ষকরা যদি সত্য কে সত্য এবং মিথ্যা কে মিথ্যা বলতে না পারে তাহলে আদর্শ শিক্ষার্থী কীভাবে তৈরি হবে। এই তো মাস কয়েক আগে কোটা আন্দোলনে তারা অনিয়ম, অত্যাচার, বৈষম্য, জুলুম এর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াইনি। নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য ক্ষমতাশীল দল রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনকে লেলিয়ে দিয়েছিল ছাত্রদের বিভিন্ন যৌক্তিক দাবির বিরুদ্ধে।
তাই এসব কিছুর পর সকলের শিক্ষা গ্রহণ করে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাজনীতিকে প্রাধান্য না দিয়ে শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি মনোনিবেশ করা উচিত। এতে শিক্ষার মান উন্নয়ন হবে, গবেষণার মান বাড়বে এবং বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ে এগিয়ে যাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
ইভা আক্তার
শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ
গণ বিশ্ববিদ্যালয়।
'বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নয়নে সুষ্ঠু ও কল্যাণময় রাজনীতি কখনো বাঁধা হতে পারে না'
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নয়নে সুষ্ঠু ও কল্যাণময় রাজনীতি কখনো বাধা হতে পারে না। স্বার্থবাদী,দলীয় লেজুড়বৃত্তিক অপরাজনীতি শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নয়নমূলক কার্যক্রমকে বাঁধাগ্রস্ত করে। বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণা ও শিক্ষার উন্নয়ন সংক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল বিষয়গুলোকে স্বজনপ্রীতি, গ্রুপিং, পক্ষপাত দুষ্টতা, গবেষণা ও পাঠদানে সময় ব্যয়ের চেয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে চেয়ার দখলের প্রবণতা ইত্যাদি বিষয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে নিরপেক্ষ ও কল্যাণমুখী শিক্ষক রাজনীতি এবং গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে ছাত্র সংসদ চালু করা গেলে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান হতে পারে বলে বিশ্বাস করি। গবেষণায় প্রণোদনাটাও খুব বেশি প্রয়োজন।
হাবিবুর রহমান,
শিক্ষার্থী, শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর
ক্যাম্পাস এর সর্বশেষ খবর