ভাগ্য বদলের ফসল বলা হয় আলুকে। আলু চাষাবাদে এলাকার অনেকের ভাগ্য বদল হওয়াসহ কৃষকরা হয়েছে স্বাবলম্বী। আগাম আলু চাষের আঁতুড়ঘর খ্যাত নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার কৃষকরা এ বছর স্থানীয় “সেভেন” জাত আলু চাষে করে করেছে বাজিমাত। ফলন ও দামে হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখে। দুই মাস ব্যবধানে বিঘায় ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা লাভ করে কৃষকরা কাড়ি কাড়ি টাকা ঢুকাচ্ছে বাড়িতে। ফলে এ বছর আলু বিক্রি করে ৮ শত কোটি টাকা কৃষকদের ঘরে ঢুকার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এতে শুধুমাত্র আলুতেই কৃষকদের আয় হবে সাড়ে ৩ শত থেকে ৪ শত কোটি টাকা।
শীতকালীন ফসল আলু দেশের প্রথম উত্তোলন হয় এ এলাকায়। আগাম আলুর আঁতুড়ঘর খ্যাত কিশোরগঞ্জে ৫৫ দিনে আলু উত্তোলন হয়। যা দেশের অন্য কোন এলাকায় হয় না। এতে বিঘা প্রতি ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা লাভবান হয় কৃষক। যা অন্য কোন ফসলে এত লাভের মুখ দেখতে পায় না। তাই এ ফসলকে ভাগ্য বদলের ফসলও বলা হয়। স্থানীয় বলা সেভেন জাতের আলু চাষে গতবছর কৃষকরা লাভের মুখ দেখায় এ বছরও কমর বেঁধে বাজিমাতের স্বপ্নে “সেভেন” জাতের আলু চাষ করে।
প্রতিবছর নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে আলু রোপণ হলেও এবার অক্টোবর মাসের শুরু হতেই আলু রোপণ করে কৃষকরা। আগাম আলুকে আগে বপন করবে, কে আগে বাজারে তুলবে, যেন প্রতিযোগিতা করে আলু রোপণ করেছে। আগে আলু তুলে কে কেজি প্রতি ৭৫ থেকে ৮০ টাকা দরে আলুর দাম পাবে। বেশি লাভবান হবে। তাই আলু বপনের উৎসবে পরিণত হয় ফসলের মাঠ। ভাওয়াইগানের তালে তালে আলু বুননে প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ।
এ বছর ২০ নভেম্বর কৃষকরা আলু উত্তোলন শুরু করেছে। দাম পেয়েছে ৯০ টাকা কেজি দরে। অন্যদিকে আজ শনিবার (০৭ ডিসেম্বর) প্রায় ১ মাস পরও আলু তুলে ফসলের মাঠেই বিক্রি করছে ৭২ থেকে ৭৩ টাকা কেজি দরে। ফলে বিঘায় কৃষকরা লাভবান হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৩ হাজার টাকা। যা আগে কোন বছরই কৃষকরা এরকম লাভের মুখ দেখেনি। তাই এখানকার কৃষকরা “সেভেন” জাত আলুতে বাজিমাতের যে স্বপ্ন দেখছিল, তা পূরণ হয়ে কৃষকরা করেছে বাজিমাত।
এ বছর কৃষি বিভাগ উপজেলায় ৬ হাজার ৭ শত ৮০ হেক্টর আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। যা ৫৫ হাজার ৮ শত ২২ বিঘা। এতে গড় ৬০ হাজার টাকা করে বিঘায় লাভ করলে এ এলাকার কৃষকরা শুধুমাত্র আলু থেকে এ বছর আয়ের টাকা ঘরে ঢুকাবে ৩ শত ৩৫ কোটি টাকা। যা রেকর্ড। অন্যদিকে এ বছর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লক্ষ ৬০ হাজার মেট্রিক টন আলু। ফলে উৎপাদন খরচ ও আয়সহ এ উপজেলার কৃষকদের ৮ শত কোটি টাকার আলু বিক্রির অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, গত বছর উপজেলায় ৬ হাজার ৬শ হেক্টর জমিতে আগাম আলু চাষ হয়েছিল। ফলে এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৭৮০ হেক্টর। যা গত বছরের তুলনায় ১শ’৮০ হেক্টর জমি বেশি। গত বছর আগাম আলু চাষ করে কৃষকরা বিঘা প্রতি ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা লাভের মুখ দেখায় এ বছর লক্ষ্যমাত্রা বেশি হয়েছে। এছাড়া কিশোরগঞ্জ উপজেলার কৃষকরা স্থানীয় সেভেন জাতের আগাম আলু চাষ করেছে। যা বপনের ৫৫ থেকে ৬০ দিন বয়সে উত্তোলন করা যায়। ৫৫ থেকে ৬০ দিনে এ ফসলে কৃষকরা যা লাভ করেন অন্য কোনো ফসলে তা লাভ হয় না। এ বছরও ৫৫ দিনে আলু উত্তোলন শুরু হয়েছে। প্রথমের দিকে ৯০ টাকা দরে কেজি বিক্রি করলেও ফলন কম ছিল। বর্তমানে ফলনও বেশি বেশ দামও পাচ্ছে কৃষকরা। ফলে আরও বেশি লাভ হচ্ছে কৃষকরা। ফলন ও দাম বেশি পাওয়ায় কৃষকদের মুখে হাঁসি ফুটেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, উৎসবমুখর পরিবেশে ভাগ্য পরিবর্তনের আগাম আলু উত্তোলনে ফসলের মাঠ প্রাণচঞ্চল মুখর হয়ে উঠেছে। দেশের প্রথম আগাম আলু উত্তোলন ঘিরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকারদের পদচারণে প্রাণচঞ্চল ফিরেছে মাঠ জুড়ে।
কিশোরগঞ্জ ইউপির ইসমাইল গ্রামের আলু চাষি আরজু জানান- আগাম ধান কেটে আগাম আলু বপন করেছিলাম। এ বছর সাড়ে ৮ বিঘা জমিতে আগাম আলু চাষ করেছি। এতে আলু বীজ, সার, কীটনাশক, শ্রমিকসহ মোট খরচ হয়েছে ৩ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে ৪ বিঘা জমির আলু উত্তোলন করে ৪ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা আলু বিক্রি করেছি। বাকী সাড়ে ৪ বিঘা জমির আলু ৫ লক্ষ টাকা বিক্রির আশা করছি। ফলে আমার সাড়ে ৮ বিঘা জমির আলু বিক্রি হবে প্রায় সাড়ে ৯ লক্ষ টাকা। উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে ৫ লক্ষ টাকা লাভের আশা করছি।
এদিকে বাহাগিলী ইউনিয়নের আলু চাষি দেলোয়ার হোসেন দুলাল জানান- এ অঞ্চলের জমিগুলো একদম উঁচু এবং বালু মিশ্রিত। ভারি বৃষ্টিপাত হলেও তেমন কোন ভয় থাকে না। তাই সেভেন জাতের আগাম আলু দ্বিগুণ লাভের আশায় বপন করেছিলাম। এ বছর ১৫ বিঘা জমি চাষ করেছি। আজ শনিবার (৭ ডিসেম্বর) ১৫ বিঘা জমির আলু উত্তোলন করে উৎপাদন হয়েছে ৩৭৫ বস্তা আলু। কেজিতে হয়েছে ২৪ হাজার ৫ শত কেজি। কেজি প্রতি ৭২ টাকা দরে বিক্রি করে ১৭ লক্ষ ৫৫ হাজার।
একই এলাকার আলু চাষী নিলু বিডিআর জানান- আমি ৮ বিঘা জমিতে সেভেন জাতের আলু রোপন করেছি। উত্তোলন শুরু করে ফসলের মাঠেই বিক্রি করে বিঘা প্রতি ৬৩ হাজার টাকা লাভ করেছি। যা গত বছরের চেয়েও বেশি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লোকমান আলম বলেন, দেশের প্রথম আলু উত্তোলন করে এ এলাকার কৃষকরা। এ এলাকার আলু বাজারে প্রথম আসায় কৃষকরা বেশ দাম পায়। ফলে এখানকার কৃষকদের ভাগ্য বদলের ফসলে পরিণত হয়েছে আলু। এ বছর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ৬ হাজার ৭৮০শ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। নভেম্বর মাসের ২০ তারিখ থেকে নতুন আলু উত্তোলন শুরু হয়েছে। যা ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে প্রায় ১ মাস পর আজ শনিবার ফসলের মাঠেই ৭২ টাকা দরে কেজি বিক্রি করে কৃষকরা বেশ লাভের মুখ দেখছে। ফসলের মাঠগুলো আলু উত্তোলনের উৎসবের মাঠে পরিণত হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর ১ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন আলু উৎপাদনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যা বাজার দর অনুযায়ী কৃষকরা ৮ শত কোটি টাকার আলু বিক্রি করবে। তার অর্ধেকেই কৃষকরা লাভবান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আলু এ এলাকার কৃষকদের ভাগ্য বদল ও স্বাবলম্বী ফসলে রুপ নিয়েছে। কৃষকরা সেভেন জাতে শুধুমাত্র বাজিমাত করেনি, সুপার বাজিমাত করেছে বলে এ কর্মকর্তা অভিমত প্রকাশ করেন।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর