মাইক্রোসফটের এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ভুয়া খবর ছড়ায় ভারতে। প্রায় ১৪৫ কোটি জণসংখ্যার এই দেশটিতে প্রতিনিয়ত গণমাধ্যম কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন ধরণের মিথ্যা, গুজব ছড়াচ্ছে।
দেশটির মিডিয়াতে যেই মিথ্যা তথ্যের সবশেষ সংযোজন ‘বাংলাদেশ’। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই বাংলাদেশকে নিয়ে একের পর এক মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে ভারতের ‘গুজব’ মিডিয়া।
সম্প্রতি বাংলাদেশের তথ্য যাচাই সংস্থা রিউমর স্ক্যানারের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের অন্তত ৪৯টি গণমাধ্যমে ভুয়া খবর ও গুজব ছড়ানো হয়েছে।
যার মধ্যে ভারতের গণমাধ্যম রিপাবলিক বাংলা সর্বাধিক ৫টি গুজব প্রচার করেছে। এরপর রয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস, জি নিউজ ও লাইভ মিন্ট; যারা প্রত্যেকে অন্তত তিনটি গুজব প্রকাশ করেছে।
এছাড়া রিপাবলিক, ইন্ডিয়া টুডে, এবিপি আনন্দ ও আজতক অন্তত দুটি করে গুজব প্রচার করেছে।
ভুয়া খবর ও গুজব ছড়ানো বাকি ৪১টি গণমাধ্যম হলো- এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল (এএনআই), এনডিটিভি, ইকোনমিক টাইমস, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ফার্স্টপোস্ট, অপি ইন্ডিয়া, ফ্রি প্রেস জার্নাল, মিরর নাউ, ইন্ডিয়া ডটকম, দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, আরটি ইন্ডিয়া, সংবাদ প্রতিদিন, জি২৪, দ্য প্রিন্ট, দ্য স্টেটসম্যান, উইয়ন, ওয়ান ইন্ডিয়া, সিএনএন নিউজ ১৮, দ্য ওয়্যার, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, এই মুহূর্তে, মাতৃভূমি, নিউজ ৯, ক্যালকাটা নিউজ, হেডলাইনস ত্রিপুরা ন্যাশনাল, টাইমস নাউ নিউজ, দ্য ওয়াল, নিউজ ২৪, পুবের কলম, ট্রিবিউন ইন্ডিয়া, এনই ইন্ডিয়া ব্রডকাস্ট, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, টিভি ৯, লোকমাত টাইমস, পিটিসি নিউজ, নিউজ এক্স, দ্য টাটভা, স্বরাজ্য, নিউজ বাইটস, ভাইবস অব ইন্ডিয়া ও বর্তমান পত্রিকা।
ভুয়া খবর ও গুজবের মধ্যে রয়েছে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর তার নামে ভুয়া খোলা চিঠি, মুসলিম ব্যক্তির নিখোঁজ পুত্রের সন্ধানে মানববন্ধন করার ভিডিওকে হিন্দু ব্যক্তির দাবিতে প্রচার, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আইসিইউতে ভর্তি হওয়ার ভুয়া খবর, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ভিত্তিহীন দাবি এবং ট্রাম্পের বিজয়ের পর ড. ইউনূসের ফ্রান্সে পালিয়ে যাওয়ার ভুয়া দাবি।
ভারতের প্রতিমা বিসর্জনের ভিডিও প্রচার করে বাংলাদেশে মুসলিমদের হামলায় হিন্দু মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের দাবি, শ্যামলী পরিবহনের বাসে হামলার মিথ্যা তথ্য প্রচার করে চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবীর ওপর হামলার ভুয়া দাবি, চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে হাসপাতালের চিকিৎসাধীন এক ব্যক্তির ছবি নিয়ে বিভিন্ন গুজব ছড়ানো হয়। দাবি করা হয়, ওই ব্যক্তি রমেন রায়, যিনি চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী। যা সত্য নয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে ‘ভাইরাল’ হওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে ভারতীয় মিডিয়া। এদের মধ্যে ‘ক্লিকবেইট’ শিরোনাম ও ‘হলুদ সাংবাদিকতা’র জ্বলন্ত উদারহণ হয়ে উঠছে উল্লেখ্যযোগ্য কিছু গণমাধ্যম।
বিশেষত রিপাবলিক বাংলা, দ্যা ওয়াল-এর মতো ‘অখাদ্য’ কিছু সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে দিনকে দিন অপতথ্য, মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে ‘ভিউ বাণিজ্য’ ও ‘ভাইরাল’ হওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
এসব গণমাধ্যমে দিনভর বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে একের পর এক অনুষ্ঠান, ফেসবুক লাইভ, মনগড়া প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছে। যেসব ‘ভুয়া খবর’ প্রচার করে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন প্লাটফর্ম থেকেও লাখ লাখ টাকা উপার্জন করছে ভারতীয় ‘গুজব’ মিডিয়া।
শুধু তাই নয়, গত ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি-মন্ত্রীসহ প্রায় ৫০০’র বেশি নেতাকর্মীসহ ভারতে প্রবেশ করেছে। এমনকি দলটির সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বর্তমানে ভারতেই অবস্থান করছেন।
এমন অবস্থায় দেশের বাইরে পাড়ি জমানো আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দদের অর্থায়নেও ভারতের কিছু মিডিয়া বাংলাদেশকে নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে বলে দাবি করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের দাবি, সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ নানাভাবেই দেশে অস্থিতীশীল পরিস্থিতির সৃষ্টির চেষ্টা করছে। দলটি মনে করছে, বাংলাদেশে অস্থিতীশীল পরিস্থিতিই পারে দেশের রাজনীতিতে তাদের পুনরায় ফিরে আসা সহজ করতে। এমন অবস্থায় তারা ভারতীয় মিডিয়ার সাহায্য নিচ্ছে। বিগত ১৬ বছরে এই দলটি যেহেতু দেশ থেকে হাজার-লাখো কোটি টাকা পাচার করেছে, ফলে আওয়ামী লীগ চাইলেই সেখান থেকে কোটি টাকা খরচ করে বিভিন্ন অপতথ্য ছড়িয়ে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারে।
ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশ নিয়ে বিভিন্ন গুজব এবং ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে, যা দুই দেশের সম্পর্ক এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। এই ধরনের অপতথ্য প্রচারের উদ্দেশ্য শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্যে প্রভাব ফেলা।
সম্প্রতি বর্ডার থেকে ভারতে ঢুকতেই পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের মনগড়া কাহিনি বলাতে বাধ্য করছে ভারতীয় প্রচার মাধ্যমের প্রতিবেদকরা, এমন দাবি করছেন ভারতে সাক্ষাৎকার দেওয়া ফরিদপুরের নিলটুলী এলাকার হিন্দু যুবকের পরিবারের সদস্যরা।
ফরিদপুর শহরের নিলটুলী এলাকার গিণি ভবণের বাসিন্দা ও স্বর্ণ ব্যবসায়ী সুনীল কর্মকারের ছেলে শুভ্র কর্মকার গত ৮ ডিসেম্বর চিকিৎসার জন্য বেনাপোল পেট্রাপোলে বর্ডার হয়ে ভারতে যায়। সীমান্ত পেরিয়েই ভারতীয় প্রচার মাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘দেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন চলছে।’
এই ঘটনার পর এই যুবকের বাবা সুনীল কর্মকার জানান, গত রোববার ভারতে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার সময় বেনাপোল বর্ডার পার হওয়ার পর তার ছেলের পাসপোর্ট দেখার কথা বলে নিয়ে নেয়। তারপর দেশের পরিস্থিতি এমন বলে সাক্ষাৎকার নেয়।
ছেলের এই মিথ্যাচারে হতবাক হয়েছেন তিনি ও তার পরিবার। সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে দাবি করে শুভ্রর বাবা সুনীল কর্মকার বলেন, ‘পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে ছেলেকে এসব বলতে বাধ্য করেছে ওই লোকগুলা।’
নির্যাতন-নিপীড়ন নিয়ে ছেলে যা বলেছে তাদের পরিবারে ও এলাকায় এমন কিছুই ঘটেনি বলে উল্লেখ করেন শুভ্রর বাবা। বরং হিন্দু-মুসলিম সবার মিলেমিশে বসবাস করার কথা বলেন তিনি।
একটা সময়ে পাকিস্তানকে ব্যবহার করা হত ভারতের অভ্যন্তরে মুসলমান-বিরোধী আখ্যান তৈরি করার জন্য। কিন্তু এখন লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে বাংলাদেশকে। সেই আখ্যানের একদিকে মুসলমানরা, তারা যে দেশেরই হোন, অন্যদিকে থাকছেন হিন্দুরা। বলার চেষ্টা করা হচ্ছে যে ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’, অর্থাৎ হিন্দুরা বিপদে আছেন।
এ বিষয়ে অল্ট নিউজের সম্পাদক প্রতীক সিনহা বলছিলেন, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে শাহিনবাগের প্রতিবাদ আন্দোলন অথবা ইসরায়েল বা এখন বাংলাদেশ- সব ক্ষেত্রেই ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে আসলে ঘুরপথে ভারতীয় মুসলমানদেরই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে। এখানকার মুসলমানদের ওপরে বিদ্বেষ ছড়ানো যাতে যুক্তিযুক্ত হিসেবে দেখানো যায়- সেই আখ্যান তৈরির প্রচেষ্টা চলছে।
ভারতীয় মিডিয়ার মিথ্যাচার নিয়ে বিবিসি বাংলাকে পুণের এমআইটি এডিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সম্বিত পাল বলেন, ‘ভারতের মিডিয়ায় এর আগে যেভাবে ভারত-বন্ধু শেখ হাসিনার প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেখিয়েছে, ঠিক সেই পথেই অধিকাংশ মিডিয়া হাসিনা সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনুস পরিচালিত অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। কারণ, তারা মনে করছে বাংলাদেশের এই সরকার ভারতের বর্তমান শাসকদলের বিরোধী।’
তার কথায়, ‘২০২১ সালে বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর আক্রমণের ঘটনা নিয়ে ভারতের মিডিয়া এতটা উচ্চগ্রামে খবর করেনি। কারণ তখন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি মোদী ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ভারতীয় মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তারা ওই অবস্থান নিয়েছিল। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতের সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা বদলিয়েছে।
সবশেষ তিনি বলেন, বাংলাদেশের হিন্দুদের নিরাপত্তার থেকে অনেক বেশি মাত্রায় ভারতের নির্বাচনী স্বার্থ এখানে কাজ করছে।
রার/সা.এ
সর্বশেষ খবর