বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কাজ পুরোদমে এগিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আগামী দুই মাসের মধ্যেই ঘোষণা হতে পারে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী-জনতার নতুন রাজনৈতিক দল। ইতোমধ্যে থানা পর্যায়ে কাজ শুরু হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্ররা জানিয়েছেন, জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই দুটি পক্ষই অরাজনৈতিক ফোরাম হিসেবে কাজ চালিয়ে যাবে। রাজনৈতিক দলটি নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করবে। চাইলে ওই দুইটি ফোরাম থেকে যে কেউ নতুন দলে যোগ দিতে পারবেন।
এদিকে নতুন যেকোনো রাজনৈতিক দলকে স্বাগত জানাতে চান রাজনৈতিক নেতারা। তবে সরকারের ছত্রছায়ায় কোনো রাজনৈতিক দল হলে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে বলে মনে করছেন বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা।
রাজনৈতিক দল গড়ার কার্যক্রম
বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট মাসে শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে প্লাটফর্ম। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা হাসিনা সরকারের পতনের পর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন নেতা এই সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ইতোমধ্যে সংগঠনটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। সেইসঙ্গে ওই আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটি নামে আরেকটি সংগঠন করা হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী আগামী দুই-এক মাসের মধ্যেই ছাত্র-জনতার নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন।
শনিবার তিনি বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের যে স্বতঃস্ফূর্ত শক্তি ছিল সেটাকে আমরা অর্গানাইজ করছি। আর সেই লক্ষ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে আমরা এখন পর্যন্ত ১০০টি থানা কমিটি দিয়েছি। আশা করি, আগামী মাসের ১৫-২০ দিনের মধ্যে সব থানা কমিটি হয়ে যাবে। এরপর আমরা ছাত্রদের কাছে এটা পেশ করব। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে, কত দিনের মধ্যে তারা কাজটি (দল গঠনের) করতে পারবে।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবেই থাকবে বলেও জানান তিনি। নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দেবেন ছাত্ররা, এমনটি উল্লেখ করে তিনি জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করবে। তবে এই দুই অংশের কেউ চাইলে নতুন রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে পারবেন।
তিনি বলেন, “আমাদের সঙ্গে বিপ্লবী, সিভিল সোসাইটি এবং পলিটিকাল তিন ধরনের লোক আছেন। যারা রাজনীতি করতে চান, নতুন রাজনৈতিক দল যদি তাদের পছন্দ হয় সেখানে তারা অবশ্যই যোগ দিতে পারবেন।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, “দুই মাসের মধ্যেই আশা করছি নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করবে। এর গঠনতন্ত্র, ঘোষণাপত্র তৈরিসহ অন্যান্য কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। দলের নাম নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। তবে এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আর দলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যান্য পদে কারা থাকবেন তা নিয়েও কাজ চলছে।”
তিনি আরও বলেন, “এটি একটি নতুন রাজনৈতিক দল হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি থাকবে অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে।”
রাজনৈতিক দলগুলোর সতর্কতা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে ইতোমধ্যে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ছত্রছায়ায় এমন রাজনৈতিক দল গঠিত হলে নিরপেক্ষতা হারাবে সরকার।
নতুন রাজনৈতিক দল গঠনকে স্বাগত জানিয়ে জাতীয় পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা একটি বিপ্লব করেছে। তারা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারে। আবার চাইলে অন্য কোনো দলে যোগও দিতে পারে।”
তবে তিনি এই বলে সতর্ক করেন যে, “অন্তর্বর্তী সরকারের সহায়তা নিয়ে, সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যদি দল গঠন করা হয় তাহলে তা বিতর্কিত হবে। অন্তর্বর্তী সরকারও তার নিরপেক্ষতা হারাবে। ফলে এই সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।”
একই মন্তব্য করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে যে কেউ রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারে। এটা তাদের অধিকার। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কোনো ব্যক্তিবর্গ, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে রাজনৈতিক দল গঠনে আনুকূল্য, অনৈতিক সহায়তা দেওয়া ঠিক হবে না। এটা করলে সরকার তার নিরপেক্ষতা বা গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আর যদি বর্তমান সরকার রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য দিয়ে দল গঠন করায় তাহলে তাদের অধীনে নির্বাচন সম্ভব হবে না। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার লাগবে।”
‘সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা’ অস্বীকার
সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বা আনুকূল্যে রাজনৈতিক দল গঠন হচ্ছে কি-না এমন এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, “আমাদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ক্ষেত্রে এমন কিছু হচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূসের কোনো রাজনৈতিক দল গঠনের ইচ্ছা নেই। যারা উপদেষ্টা আছেন তাদেরও ইচ্ছা নেই। যারা এটা বলছে তারা সংকট সৃষ্টি করার জন্য বলছে।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, “এটি একটি নতুন রাজনৈতিক দল হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি থাকবে অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে।”
তিনি দাবি করেন, “অন্তর্বর্তী সরকারে বৈষম্যবিরোধী বা নাগরিক কমিটির কেউ নেই। ফলে সরকারের সহযোগিতায় দল বা কিংস পার্টি করার প্রশ্নই আসে না। আর সেটা হলে সরকারতো আমাদের সব দাবি মেনে নিতো। তা তো হচ্ছে না।”
‘দ্রুত নির্বাচন চাইবে নতুন রাজনৈতিক দল’
ছাত্রদের এই রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচন চাইবে। তবে তার আগে সংস্কারের কাজ এবং ২০২৪ সালের আন্দোলনের সময়কার ঘটনার বিচারকার্যের ওপর গুরুত্ব দেন এই দুই মুখপাত্র।
নির্বাচন ও সংস্কার বিষয়ে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, “আমরা চাই বাংলাদেশ দ্রুত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করুক। কিন্তু যারা বাংলাদেশের দুই হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, ৫০ হাজার মানুষের চোখ ও অঙ্গ কেড়ে নিয়েছে তাদের বিচার আমরা আগে চাই। ১৯৭১ এবং ১৯৯০-এর বিচার আমরা পাইনি। সুতরাং ২০২৪-এর বিচার আমরা না পাওয়া পর্যন্ত ওই প্রক্রিয়ায় (নির্বাচন) যাওয়া উচিত হবে বলে মনে করি না।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, “নতুন দল দ্রুতই নির্বাচন চাইবে। তবে তার আগে সংস্কার হতে হবে, যাতে আর কেউ স্বৈরাচার হতে না পারে। গণতন্ত্র হরণ করতে না পারে।”
বাঁধন/সিইচা/সাএ
সর্বশেষ খবর