অসময়ে ঝরে যাওয়া একটি ফুলের নাম শহীদ হৃদয় তরুয়া (২২)। কোটা না মেধার প্রশ্নে মেধাই ছিল হৃদয়ের একমাত্র উত্তর। স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষ করে পরিবারের দুঃখ-দুর্দশা ঘুচাবে। কিন্তু পূরণ হলো না তার সেই স্বপ্ন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে জীবন প্রদীপ নিভে গেছে তার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়াকে হারিয়ে তার বাবা-মা পাগল প্রায়। আর ভাইকে হারিয়ে বোন মিতু রানীও নির্বাক। হৃদয় চন্দ্র তরুয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (সম্মান) ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
গত ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন হৃদয়। আহত অবস্থায় চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। পরে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে নেওয়া হলে সেখানে ৬ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ২৩ জুলাই ভোর সাড়ে ৫টার দিকে মৃত্যুর কাছে হেরে যান হৃদয় তরুয়া।
পটুয়াখালীর রতন চন্দ্র তরুয়া ও অর্চনা রানী তরুয়ার এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে হৃদয় ছিলেন ছোট। গ্রামের বাড়ি মির্জাগঞ্জ উপজেলার ঘটকের আন্দুয়া গ্রামে। বাবা রতন তরুয়া কাঠমিস্ত্রি, মা অর্চনা রানী গৃহপরিচারিকা। ছেলেমেয়েকে পড়ালেখা করাতে প্রায় এক যুগ আগে পটুয়াখালী জেলা শহরের মুন্সেফপাড়া এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন তারা। বাবা-মার দুজনের রোজগারে খুব কষ্টে চলত তাদের সংসার। অভাবের টানাপড়েনের সংসারে এইচএসসি পাসের পরই মেয়ে মিতুকে বিয়ে দেন রতন তরুয়া। একমাত্র পুত্রকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে ভর্তি করান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
হৃদয় তরুয়া ২০১৮ সালে পটুয়াখালী সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি এবং ২০২০ সালে পটুয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। স্কুলে পড়াকালে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে খেলাঘর আসরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পড়ালেখার পাশাপাশি যখনই সময় পেতেন ছুটে যেতেন মঞ্চে সহকর্মীদের আনন্দ আড্ডায়। মঞ্চে দাঁড়িয়ে দরাজ কণ্ঠে গাইতেন - আমরা মানুষের জয়গান গেয়ে যাই, আমরা জীবনের জয়গান গাই আহা হা-যুদ্ধ চাই না- আমরা ধ্বংস চাই না- আমরা পৃথিবীতে শান্তির পতাকা উড়াই। যুদ্ধ না চাওয়া ছেলেটা মানুষের মুক্তির জন্যে, মানুষের অধিকারের জন্যে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন খেলাঘর কর্মী হৃদয়। আর কখনোই মঞ্চে কোরাস দলে দাঁড়িয়ে গলায় লাল স্কার্ফ পরে গাইবেন না মানুষের জয়গান।
পটুয়াখালীতে শহীদ হৃদয় তরুয়ার স্মৃতির প্রতি ও দেশের জন্যে শহীদ হৃদয়ের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা রেখে পটুয়াখালী পৌরসভার সার্কিট হাউস সংলগ্ন ঝাউতলা রোডে অবস্থিত গোলচত্বরটির নাম দেয়া হয় ‘শহীদ হৃদয় তরুয়া চত্বর’। গত ২০২৪ সালের ৮ নভেম্বর পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফিন শহীদ হৃদয় তরুয়া চত্বরের উদ্বোধন করেন।
হৃদয় তরুয়ার স্মরণে এই চত্বর তার সাহসী আন্দোলনের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে চিরকাল আমাদের মাঝে থেকে যাবে এবং তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে বলে মনে করেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাগর চৌধুরী। সাগর আরও বলেন, যখনি অন্যায় হয়েছে তখনি ছাত্ররা প্রতিবাদ করেছে। আমরা মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করেছি। যতবার এই বাংলায় বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে তার মূল সারিতে ছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা। যদি আবার প্রয়োজন হয় তবে আবার পথে নামবো, লড়াই করবো। আমাদের শহীদ হৃদয় তরুয়ার নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ আমাদের লড়াই-সংগ্রামের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
অর্চনা রানী বলেন, ‘ছেলেটার স্বপ্ন ছিল সে পড়ালেখা শেষ করে চাকরি নিয়ে আমাদেরকে তার কাছে রাখবে এবং আমাদের কাজকর্ম কিছু করতে দেবে না। শুধু বলত, মা তোমরা আর তিনটা বছর একটু কষ্ট করো। এর পরই আমি তোমাদের নিয়ে ঢাকায় থাকব। ভগবান যে এভাবে আমার ছেলেটাকে নিয়ে যাবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। আর যেন কোনো মায়ের বুক এভাবে খালি না হয়।’
বাবা রতন চন্দ্র তরুয়া বলেন, ‘আমাদের একমাত্র ভরসা ছিল হৃদয়। ওকে নিয়েই ছিল আমাদের সব স্বপ্ন। কিন্তু সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। আমার সন্তানকে তো কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু সুষ্ঠু বিচার চাই। এটাই আমাদের একমাত্র চাওয়া।’
বোন মিতু রানী তরুয়া বলেন, ‘যারা আমার ভাইকে গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক বিচার করা হোক, এটাই আমাদের একমাত্র দাবি।’
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর