
যেন হলুদ রঙের গালিচায় সেজেছে কিশোরগঞ্জের ফসলের মাঠ। ফুলের মৌ মৌ গন্ধ, আর মৌমাছির গুঞ্জন মনকে বিমোহিত করে। এ রকম মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য।
হলুদ রঙের গালিচায় সেজেছে কিশোরগঞ্জের ফসলের মাঠ। সরিষা ফুলের মৌ-মৌ গন্ধে বিমোহিত ফসলের প্রান্তর। সরিষার এমন ফলনে কিষাণ-কিষাণির মুখে জেন তৃপ্তির হাসি।
জেলার ফসলের মাঠে মাঠে এখন হলুদ সরিষা ফুলের হাসি। শীতের হিমেল বাতাসে দোল খাচ্ছে হলুদ সরিষার ফুল। দেখে মনে হয় যেন প্রকৃতি সেজেছে সুন্দর হলুদের সাজে।
গত বছরের তুলনায় এবার বেড়েছে সরিষার চাষ। ভোজ্য তেলের দাম ও চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা সরিষা চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবারও কিশোরগঞ্জে সরিষা ফলনের বাম্পার ফলনের আবাদ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে বলে মনে করছেন কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, আবাদি জমিগুলো ছেয়ে গেছে হলুদ সরিষার রঙে। মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে সরিষার জমিতে।
কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এবার জেলার ১৩টি উপজেলায় মোট ১২ হাজার ১৭০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। তারমধ্যে ১১ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে উফশী ও ১ হাজার ৭০ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের সরিষা চাষ করা হয়েছে। জেলার সদর উপজেলায় ৪১৫ হেক্টর জমিতে উফশী জাতের সরিষা চাষ করা হয়েছে। হোসেনপুর উপজেলায় ৩৫০ হেক্টর জমিতে উফশী জাতের সরিষা চাষ করা হয়েছে। পাকুন্দিয়া উপজেলায় ৫৭০ হেক্টর জমিতে উফশী জাতের সরিষা চাষ করা হয়েছে। কটিয়াদী উপজেলায় ৩৬৫ হেক্টর জমিতে উফশী জাতের সরিষা চাষ করা হয়েছে। করিমগঞ্জ উপজেলায় ২৬১০ হেক্টর জমিতে উফশী ও ৪৩ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের সরিষা চাষ করা হয়েছে। তাড়াইল উপজেলায় ৮৩৭ হেক্টর জমিতে উফশী ও ৫৫০ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের সরিষা চাষ করা হয়েছে। ইটনা উপজেলায় ৫২০ হেক্টর জমিতে উফশী জাতের সরিষা চাষ করা হয়েছে। মিঠামইন উপজেলায় ২৩০ হেক্টর জমিতে উফশী জাতের সরিষা চাষ করা হয়েছে। নিকলী উপজেলায় ২৮০ হেক্টর জমিতে উফশী জাতের সরিষা চাষ করা হয়েছে। অষ্টগ্রাম উপজেলায় ২৬০ হেক্টর জমিতে উফশী ও ৫০ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের সরিষা চাষ করা হয়েছে। বাজিতপুর উপজেলায় ১৭৫৫ হেক্টর জমিতে উফশী ও ২০৫ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের সরিষা চাষ করা হয়েছে। কুলিয়ারচর উপজেলায় ২৫৮ হেক্টর জমিতে উফশী ও ২ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের সরিষা চাষ করা হয়েছে। ভৈরব উপজেলায় ২৬৫০ হেক্টর জমিতে উফশী ও ২২০ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের সরিষা চাষ করা হয়েছে। তাতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ হাজার মেট্রিক টনের উপরে।
জানা গেছে, জেলার হাওর, নদ-নদী চর-অধ্যুষিত এলাকাসহ খাল-বিল পাড়ে মাঠে মাঠে এখন সরিষা ফুলের হলুদ রঙের সমারোহ। চারদিকে হলুদ গালিচা বিছিয়ে যেন অপরূপ সাজে সেজেছে ফসলের মাঠ। এ ফুলের মৌ-মৌ গন্ধ আর মৌমাছিদের গুঞ্জনে মুখর হচ্ছে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের প্রান্তর এ নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে বাড়ছে প্রকৃতি প্রেমিকদের আনাগোনা। প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধানসহ অন্যান্য খাদ্যশস্য উৎপাদন করে ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। তাই এ অঞ্চলের কৃষকেরা অল্প সময়ে ও অল্প খরচে উৎপাদিত বেশি দামে বিক্রিয় যোগ্য ফসল সরিষা ব্যাপক হারে চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। ভোজ্য তেলের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে এ ফসলটির উপযুক্ত মূল্যও রয়েছে বাজারে।
বছরের বাংলা সনের কার্তিক মাসের শেষের দিকে সরিষা ফসল চাষ হয়। পৌষ মাসের মাঝামাঝি সময়ে এর কর্তন হয়। বিশেষ করে হাওরসহ জেলার অন্য উপজেলাগুলোতে বোরো ফসল কাটা শেষে নিম্নাঞ্চল জমিগুলো পানির নিচে তলিয়ে যায়। কার্তিক মাসের দিকে পানি সরে গেলে আরেকটি বোরো ফসলের মৌসুম শুরুর মাঝ সময়ে চাষ হয় তেলজাতীয় রবি ফসল সরিষা। এ জন্য চাষিরা এ ফসলটিকে ‘ফাউ’ ফসল হিসেবে গভীর মনোযোগ ও গুরুত্বের সঙ্গে চাষ করে থাকে।
এছাড়া বাজারে বিক্রির আগেও এ ফসলের ফুল দিয়ে মুখরোচক বড়া ও পাতা দিয়ে মজাদার শাক রান্না করা এবং কর্তন শেষে সরিষা গাছ শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার কারণে এসব বিক্রি করেও পাওয়া যায় বাড়তি অর্থ।
দেশের অন্যতম সরিষা ফসল উৎপাদনকারী হাওর-অধ্যুষিত কিশোরগঞ্জে জেলার ফসলের মাঠ জুড়ে এখন হলুদ সরিষা ফুল। যে দিকেই তাকানো যায়, মনে হয় হলুদ রঙের গালিচায় ছেয়ে আছে এখানকার মাঠঘাট- প্রান্তর এ নয়নাভিরাম দৃশ্য ভিন্ন রকম দোলা দিয়ে যায় গ্রামবাংলার মানুষের মনে।
সরিষা ক্ষেত দেখতে আসা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নাজনীন সুলতানা (৪৮) গৃহিণী নুসরাত সুলতানা (৪৫) শিক্ষার্থী অতুল (১৫) তানিয়া (২৫) এবং মীরা (১৪) বলেন, চলতি শীতের মৌসুমে মাঠে মাঠে সবুজের ডগায় সরিষা ফুলের সমারোহ দেখে মন ছুঁয়ে যায়। মৌ মৌ ঘ্রাণ, বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি, মৌমাছি, ভ্রমর এবং পাখির কলরবে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ফুলের সৌন্দর্য দেখতে আর সুবাস নিতে এসেছি। ছবিও তুলেছি। সরিষা লাভবান একটি ফসল। কম খরচে বেশি লাভ হয়।
কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, অন্তর্বর্তী সময়ে নামমাত্র খরচে চাষ করে উপযুক্ত দাম পাওয়ায় কৃষকরা অধিক হারে সরিষা আবাদের দিকে ঝুঁকছেন। অধিক পরিমাণে সরিষা উৎপাদনের ফলে এবার সারা দেশে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার তেল কম আমদানি করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এ বছর জেলায় ১২ হাজার ১৭০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ হাজার মেট্রিক টনের উপরে। তবে বাম্পার ফলনের আশা থাকায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।
কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের সরেজমিন গবেষণা বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডক্টর মোহাম্মদ মহিউদ্দীন জানান, কিশোরগঞ্জ জেলায় এ বছর ১২ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে পাইলট প্রোগ্রাম হিসেবে সদর উপজেলার রশিদাবাদে বারি সরিষা-১৪ জাতটি আবাদ হয়েছে ৯ একর জমিতে। এই জাতটি ৭৫-৮০ দিনের মধ্যে কর্তন করা যায়। প্রতি কাঠায় ফলন হয় ২-৩ মণ।
তিনি আরো বলেন, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ থেকে কৃষকদেরকে বীজ, সার ও কীটনাশক দেওয়া হয়েছে। তৈলবীজ গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ডক্টর মো. মনিরুল ইসলাম জানান, এ পর্যন্ত সরিষার ২২ টি জাত আবিষ্কার হয়েছে। এর মধ্যে বারি সরিষা-১৪ স্বল্প মেয়াদী। এটা বপন থেকে শেষ পর্যন্ত ৭৫-৮০ দিন সময় লাগে।
কৃষক আমন ধান করার পরে অল্প সময়ের জন্য বারি সরিষা-১৪ চাষ করে সহজেই বোরো ধান আবাদ করতে পারে। ফলনেও এটা ভালো। প্রতি হেক্টরে ১৪০০-১৬০০ কেজি ফলন হয়ে থাকে। এ জন্য কৃষকরা এটি সহজে গ্রহণ করেন বলে জানান তিনি।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর